কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাদিরা খানমের বিরুদ্ধে ঘুষ বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য, ভর্তি বানিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, অনুষ্ঠান বানিজ্য, সাক্ষর জালিয়াতি সহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতার মেয়ে নাদিরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদেপদে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গায়ের জোরে এসব অনিয়ম দুর্নীতি করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ গুলো খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে তদন্ত কমিটি।
কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলীর মেয়ে নাদিরা খানম শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে টু শব্দ করতে পারেনি কেউ। তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ তুললে বা দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না কেউ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সিনিয়রদের জিম্মি করে তার কথা মতো চলতে বাধ্য করতেন নাদিরা। তার অপকর্মে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা অতিষ্ঠ৷ তার শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ থেকে বদলী হয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে যোগদান করেন একজন নারী প্রভাষক। কাগজপত্র জাল জালিয়াতির মাধ্যমে তাকে অন্য একজন প্রভাষকের স্ত্রী বানিয়ে এক ছাত্রীকে কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে যার মেয়েকে ভর্তি করা হয়েছে তিনিও একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক। কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে এমন জালিয়াতি করেছেন কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাদিরা খানম। একজন সরকারি চাকরিজীবীর বদলির আদেশ দেখিয়ে অন্যের সন্তানকে অর্থের বিনিময়ে ভর্তি করান তিনি। এছাড়াও একজন চিকিৎসকের মেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় না টিকলেও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাকে ভর্তি করান নাদিরা। তার বিরুদ্ধে এরকম অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক উদাহরণ রয়েছে।
বাবার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি বাণিজ্য করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন নাদিরা। দুদক তদন্ত করলে তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাবে বলে দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার মেয়ে নাদিরা খানম বিভিন্ন পাবলিকেশনের কাছ থেকে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে চুক্তি করতেন। এরপর পছন্দের গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করতেন। বেশিরভাগ সময় লেকচার পাবলিকেশনের সাথে চুক্তি করে কমিশন বানিজ্য করেছেন নাদিরা। এছাড়াও ২০২১ সালে নাদিরা খানমের আপন ভাইয়ের মেয়ে লটারিতে ভর্তির সুযোগ পায় না। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও শ্রেনি শিক্ষককে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তার ভাইয়ের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত।
সোহেলী আফরোজ কুষ্টিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সে নাদিরা খানমের কথা মতো অনিয়ম দুর্নীতি করতেন না। বরং তার অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। এজন্য সোহেলীকে ফাঁসাতে উঠে পড়ে লাগে নাদিরা। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বলে অভিযোগ তুলে তৎকালীন কুষ্টিয়া সদর আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের সুপারিশে তাৎক্ষনিক (২৪ ঘন্টার মধ্যে) প্রধান শিক্ষক সোহেলী আফরোজকে বদলি করে। ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে এ ঘটনা ঘটেছে৷
নাদিরা খানমের অনিয়ম দুর্নীতি, অত্যাচার ও অপকর্মে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন৷ তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক অতিরিক্ত ক্লাস করতে বাধ্য করেন। অতিরিক্ত ক্লাস না করলে বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি ও পরীক্ষায় নম্বর কম দেন। একইসাথে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন।
স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃত শেফালী রহমানের স্বাক্ষর নকল করে খন্ডকালীন কর্মচারী হিসেবে হাসিবুল নামে একজনকে নিয়োগ প্রদান করে নাদিরা খানম। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে কয়েক লাখ টাকার নিয়োগ বানিজ্য করে সে। শুধু তাই না, স্কুলের একাধিক ফান্ডের সদস্য হয়ে প্রধান শিক্ষককে ভয়ভীতি দেখিয়ে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। সরকারি ফান্ড, বেসরকারি ফান্ড, টিফিন, অভ্যন্তরিন পরীক্ষা, ম্যাগাজিন, সাংস্কৃতি, বিদায়, মিলাদ
সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেন৷ এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সহ একাধিক রুম দখল করে ব্যক্তিগত কাজ করে আসছেন তিনি।
অভিযোগকারীরা বলেন, শিক্ষক নাদিরা খানম কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলীর মেয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাবার প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তিনি তার বাবা ও ভাইয়ের পোষা মাস্তান দ্বারা হুমকি ধামকি প্রদান এবং বদলী করে দেওয়ার ভয় দেখান। দীর্ঘদিন ধরে তার অত্যাচার সহ্য করে করে আসছে অভিভাবক ও শিক্ষকরা। তিনি ঘুষ বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য, ভর্তি বানিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ, অনুষ্ঠান বানিজ্য, সাক্ষর জালিয়াতি সহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে। তিনি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাদিরা খানম বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি কোনো প্রকার অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত না। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ওই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক আমাকে ফাঁসানোর জন্য উঠে পড়ে ফেলেছে। আমার অপরাধ একটা-ই যে, আমি আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ে। এছাড়া আমার কোনো অপরাধ নেই।
এবিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা অফিসার আবু তৈয়ব মো. ইউনুছ আলী বলেন, কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাদিরা খানমের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের তদন্ত চলছে। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।