ঢাকা ০২:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশের সংঘর্ষে দুই পক্ষই দায়ী — বিচার বিভাগীয় তদন্তে নতুন তথ্য উদঘাটন

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ১১:০৬:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • ৫২৬ বার পড়া হয়েছে

 

গত জুলাই মাসে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষই দায়ী বলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে উঠে এসেছে।

সরকার গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উসকানি, গুজব, দুই পক্ষের অনঢ় অবস্থান এবং প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা — সবকিছু মিলেই এই সংঘাতকে “অবশ্যম্ভাবী” করে তুলেছিল।

কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রতিবেদনে ৮-১০টি সুপারিশ এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে পাঁচটি করণীয় তুলে ধরা হয়েছে। তবে সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যু হলেও কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে— সেটি কমিশনের তদন্তপরিধিতে ছিল না।

সংঘর্ষের কারণ

তদন্তে উঠে এসেছে, এনসিপির “দেশব্যাপী সমাবেশ” কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ রাখাই ছিল উত্তেজনা বাড়ার সূচনা। স্থানীয়রা একে শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিকে ঘিরে উসকানিমূলক ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

এরপর এনসিপি সমাবেশে “মুজিববাদ মুর্দাবাদ” স্লোগান শোনা গেলে স্থানীয় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ভুল বোঝাবুঝি ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, এনসিপি কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সমাধি ভাঙতে পারে। এরপর মসজিদ থেকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয়দের রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয় এবং সহিংসতা শুরু হয়।

সাজ্জাদ সিদ্দিকীর ভাষায়,

“গোপালগঞ্জবাসীর বিশেষ ট্রাইবালিজম, আওয়ামী লীগ কর্মীদের জাতীয় পরিবর্তন মেনে না নেওয়া, আর এনসিপির অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস—এই তিনটি উপাদান সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল।”

জড়িত কারা

তদন্তে গণমাধ্যম, ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে দেখা গেছে, সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ সংঘর্ষে অংশ নেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

কমিশনের সুপারিশ

কমিশন রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের ক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এছাড়া

  • উসকানিমূলক বক্তব্য ও শব্দচয়নে সতর্ক থাকা,
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনে বডি ক্যামেরা ব্যবহার,
  • স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো,
  • নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান,
  • এবং পেশাদারভাবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা— এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশন আরও বলেছে,

“যদি কেউ ইচ্ছাকৃত বা অসর্তকভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়, যার ফলে সহিংসতা সৃষ্টি হয়—তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

গুলির তদন্ত

সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। প্রাথমিকভাবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হলেও পরে চারজনের মরদেহ উত্তোলন করে পোস্টমর্টেম করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ ছিল “রক্তক্ষরণ ও শক, যা পূর্ববর্তী আঘাতের ফলে ঘটেছে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতির ছিল।”

তবে গুলি কারা চালিয়েছিল, তা তদন্ত কমিশনের কার্যপরিধির বাইরে ছিল। সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন,

“কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে, সেটা নির্ধারণে ফরেনসিক বা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। দায় নির্ধারণ খুব জরুরি।”

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া

আইএসপিআর জানায়, গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনী “আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়” এবং সে বিষয়ে ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছিল।

সরকার এখনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি

তদন্ত কমিশন সেপ্টেম্বরের শেষে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও এখনো তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি

সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন,

“এই প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সরকারের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। জনগণকে ওয়াকিবহাল করা সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির জন্য জরুরি।”


 

জনপ্রিয় সংবাদ

পুরান ঢাকায় দিনের বেলায় গুলিতে নিহত ১ : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় চাঞ্চল্য

গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশের সংঘর্ষে দুই পক্ষই দায়ী — বিচার বিভাগীয় তদন্তে নতুন তথ্য উদঘাটন

আপডেট সময় ১১:০৬:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

 

গত জুলাই মাসে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষই দায়ী বলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে উঠে এসেছে।

সরকার গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উসকানি, গুজব, দুই পক্ষের অনঢ় অবস্থান এবং প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা — সবকিছু মিলেই এই সংঘাতকে “অবশ্যম্ভাবী” করে তুলেছিল।

কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রতিবেদনে ৮-১০টি সুপারিশ এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে পাঁচটি করণীয় তুলে ধরা হয়েছে। তবে সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যু হলেও কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে— সেটি কমিশনের তদন্তপরিধিতে ছিল না।

সংঘর্ষের কারণ

তদন্তে উঠে এসেছে, এনসিপির “দেশব্যাপী সমাবেশ” কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ রাখাই ছিল উত্তেজনা বাড়ার সূচনা। স্থানীয়রা একে শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিকে ঘিরে উসকানিমূলক ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

এরপর এনসিপি সমাবেশে “মুজিববাদ মুর্দাবাদ” স্লোগান শোনা গেলে স্থানীয় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ভুল বোঝাবুঝি ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, এনসিপি কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সমাধি ভাঙতে পারে। এরপর মসজিদ থেকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয়দের রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয় এবং সহিংসতা শুরু হয়।

সাজ্জাদ সিদ্দিকীর ভাষায়,

“গোপালগঞ্জবাসীর বিশেষ ট্রাইবালিজম, আওয়ামী লীগ কর্মীদের জাতীয় পরিবর্তন মেনে না নেওয়া, আর এনসিপির অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস—এই তিনটি উপাদান সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল।”

জড়িত কারা

তদন্তে গণমাধ্যম, ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে দেখা গেছে, সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ সংঘর্ষে অংশ নেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

কমিশনের সুপারিশ

কমিশন রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের ক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এছাড়া

  • উসকানিমূলক বক্তব্য ও শব্দচয়নে সতর্ক থাকা,
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশনে বডি ক্যামেরা ব্যবহার,
  • স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো,
  • নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান,
  • এবং পেশাদারভাবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা— এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশন আরও বলেছে,

“যদি কেউ ইচ্ছাকৃত বা অসর্তকভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়, যার ফলে সহিংসতা সৃষ্টি হয়—তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

গুলির তদন্ত

সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। প্রাথমিকভাবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হলেও পরে চারজনের মরদেহ উত্তোলন করে পোস্টমর্টেম করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ ছিল “রক্তক্ষরণ ও শক, যা পূর্ববর্তী আঘাতের ফলে ঘটেছে এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতির ছিল।”

তবে গুলি কারা চালিয়েছিল, তা তদন্ত কমিশনের কার্যপরিধির বাইরে ছিল। সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন,

“কার গুলিতে মৃত্যু হয়েছে, সেটা নির্ধারণে ফরেনসিক বা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। দায় নির্ধারণ খুব জরুরি।”

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া

আইএসপিআর জানায়, গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনী “আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়” এবং সে বিষয়ে ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছিল।

সরকার এখনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি

তদন্ত কমিশন সেপ্টেম্বরের শেষে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও এখনো তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি

সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন,

“এই প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সরকারের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। জনগণকে ওয়াকিবহাল করা সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির জন্য জরুরি।”