জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ার স্বনামধন্য শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা মাহবুবুল হক কাসেমী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর মিরপুর-২ কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৩ বছর। তাঁর ইন্তেকালের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ছেলে মুহাম্মদ মারগুবুল হক। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ডায়াবেটিসজনিত রোগে ভুগছিলেন।
মরহুম মাওলানা মাহবুবুল হক কাসেমী ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর থানার নলবুনিয়া গ্রামে এক দ্বীনি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা শামসুল হক এবং দাদা মৌলভি নাজেম আলী হাওলাদার। মাতুল ও পিতুল উভয় দিক থেকেই আলেম পরিবারে লালিত-পালিত হয়ে তিনি শৈশবেই দ্বীনি শিক্ষার পথে অগ্রসর হন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৭৩–৭৫ সালে দারুল উলুম বাদুরা মাদরাসায় উর্দু, ফার্সি ও মিযান জামাত সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার কাজুলিয়া মাদরাসায় নাহবেমীর ও হেদায়াতুল্লাহ জামাত শেষ করেন। ১৯৭৮ সালে গরহরডাঙ্গা দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা থেকে কাফিয়া জামাত সমাপ্ত করে বোর্ড পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৭৯–৮১ সালে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে শরহে জামী, শরহে বেকায়া ও হেদায়া জামাত সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮২–৮৫ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে জালালাইন, মেশকাত, তাকমিলে দাওরা ও তাকমিলে আদব অধ্যয়ন করেন। মেশকাত জামাতে কৃতিত্বের সঙ্গে মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ ফলাফলের কারণে ইফতা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেও তৎকালীন সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা মেরাজুল ইসলাম (রহ.)-এর পরামর্শে তাকমিলে আদবে অধ্যয়ন অব্যাহত রাখেন।
১৯৮৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উর্দু সাহিত্যে মাস্টার্স সমমানের কামেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রশংসনীয় ফলাফল অর্জন করেন এবং একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হন। একই সময়ে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে খোশখাত (ক্যালিগ্রাফি) বিষয়ে বিশেষ সনদও লাভ করেন।
শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয় ভারতের রাজস্থানের জামিয়া লতিফিয়ায়। ১৯৮৬–৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে বুখারি শরিফ, তিরমিজি, মুসলিম ও মিশকাত শরিফের দরস প্রদান করেন। পরে ১৯৯১–৯৮ সালে জামিয়া রহমাতুল্লাহ আমলাপাড়া মাদরাসা এবং ১৯৯৯–২০০০ সালে জামিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটারা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। ২০০০ সালে জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়ায় দাওরায়ে হাদিস চালু হলে তিনি সেখানে বুখারি ও তিরমিজি শরিফের দরস শুরু করেন। দীর্ঘদিন নাজেমে তালীমাতের দায়িত্ব পালনসহ আমৃত্যু লালমাটিয়া মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি লালমাটিয়ার পাশাপাশি লালবাগ জামিয়া শায়েখিয়া, জামিয়া আবরারিয়া কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন মাদরাসায় বুখারি শরিফের দরস প্রদান করেন। ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক কেল্লা শাহী মসজিদে নিয়মিত খতিবের দায়িত্বও পালন করেন।
ইসলাহ ও তাসাউফের ক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে হযরত মাওলানা মছিহুল্লাহ খান জালালাবাদী (রহ.)-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ আবরারুল হক (রহ.) এবং হযরত আল্লামা মাওলানা কমরুদ্দীন সাহেবের হাতে রুজু ও বাইআত গ্রহণ করে খেলাফত লাভ করেন।
মরহুম আলেম সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে সফর করে দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি মৃত্যুকালে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর ইন্তেকালে দেশের আলেম সমাজ, ছাত্রবৃন্দ ও ভক্ত-অনুরাগীদের মাঝে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাঁকে গ্রামের বাড়ি নলবুনিয়ায় দাফন করা হবে।




















