বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে বহু নক্ষত্রের উত্থান-পতন ঘটেছে। কেউ ইতিহাসে দীপ্তিময়, কেউবা ক্ষণিকের আলো হয়ে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু কিছু নাম থাকে, যাদের সঙ্গে দেশের ইতিহাস অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়ে—দুঃসময়, সংগ্রাম, উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নের সঙ্গে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারেক রহমান তেমনই এক নাম।
আজকের বাংলাদেশে ‘অপেক্ষা’ শব্দটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য ধারণ করেছে। এই অপেক্ষা কেবল একজন নেতার জন্য নয়; এটি গণতান্ত্রিক ভারসাম্য, নেতৃত্বের শূন্যতা, দীর্ঘ রাজনৈতিক একমুখিনতার অবসান এবং একজন অসুস্থ মায়ের সন্তানের জন্য আকুল প্রতীক্ষার সম্মিলিত প্রতিফলন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসাজনিত সংকট, জনগণের আবেগ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে তারেক রহমানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক গভীর জাতীয় প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ আজ এক অদ্ভুত রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক আধিপত্য বিরোধী রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। যুক্তিনির্ভর বিতর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আজ প্রায় অনুপস্থিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একমুখী শাসনব্যবস্থা কখনো দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি আনে না; বরং তা ভবিষ্যৎ সংকটের বীজ বপন করে। এই বাস্তবতায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আবারও সামনে এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে জনগণের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই নিবদ্ধ হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকে। তাঁর প্রতি প্রত্যাশা কেবল একটি দলের পুনর্গঠনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভূগোলকে ভারসাম্যপূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা এতে জড়িত।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান আজ কেবল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি নন, বরং একটি প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছেন। তিনি এমন এক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরি, যা বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী চেতনা ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। জিয়াউর রহমানের বাস্তববাদী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনের উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছেন নতুন সময়ের ভাষায়।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠন, শিক্ষিত তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা, আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার ব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকট, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মধ্যেও তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তা তাঁকে ভেঙে দিতে পারেনি। ইতিহাস বলে, ঝড়ের সময় যে নেতৃত্ব টিকে থাকে, ভবিষ্যৎও তার হাতেই নিরাপদ থাকে।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা আজ একটি গভীর মানবিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। তিনি কেবল তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নন; তিনি একজন মা, একজন সংগ্রামী নারী এবং একটি প্রজন্মের আবেগের প্রতীক। তাঁর শারীরিক দুর্বলতা আজ দেশের মানুষের মধ্যে গভীর সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে। অসুস্থ মায়ের পাশে সন্তানের থাকা—এটি কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়, এটি মানবিকতার মৌলিক ভাষা। সেই মানবিক আবেদন আজ জাতির আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে।
এই আবেগ ও বাস্তবতার সংযোগস্থলেই তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নটি রাজনৈতিক তাৎপর্য পেয়েছে। দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন শেষে তাঁর দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মনে একটি পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে গেঁথে গেছে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, স্বচ্ছ নির্বাচন, আইনের শাসন, যুবসমাজের ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্ব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শহরের পাঠাগার, রিকশাচালকের কথোপকথন থেকে প্রবাসীদের আড্ডা—একটি নামই আজ বারবার উচ্চারিত হয়। এই উচ্চারণ নিছক দলীয় আনুগত্য নয়; এটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক একঘেয়েমির বিরুদ্ধে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা।
তারেক রহমানের প্রতি এই অপেক্ষার পেছনে তিনটি স্তর স্পষ্ট। প্রথমত, রাজনৈতিক—গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সামাজিক—খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও মানবিক সহানুভূতি। তৃতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক—সংকটে বাঙালির নায়ক খোঁজার প্রবণতা। এই তিন স্তরের সংমিশ্রণেই তারেক রহমান আজ একটি জাতীয় প্রত্যাশার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একজন নেতার প্রত্যাবর্তন, একজন মায়ের আকুলতা এবং একটি জাতির রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে মিলেছে। এই প্রতীক্ষা কেবল রাজনীতির নয়—এটি মানবিক, সামাজিক ও প্রজন্মগত স্বপ্নের প্রতিফলন।
দেশ যেন নীরবে একটিই কথা বলছে—
তারেক রহমানের অপেক্ষায় আজ পুরো বাংলাদেশ।
লেখক: উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়


























