ঢাকা ১০:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খালেদা জিয়ার ছায়াসঙ্গী ছিলেন এই ফাতেমা

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ০৯:০২:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৫৩৮ বার পড়া হয়েছে

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন ফাতেমা। এক সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কটাক্ষ করে বলেছিলেন, কারাগারেও খালেদা জিয়ার ফাতেমাকে প্রয়োজন হবে।

রাজনীতির ইতিহাসে আলোচনায় আসে নেতা, আন্দোলন, ক্ষমতা কিংবা কারাবাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের আড়ালে থেকে যান কিছু নীরব মুখ—যারা আলোয় নয়, ছায়ায় থেকেই সময়ের সাক্ষী হন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এমন এক ছায়াসঙ্গীর নাম ফাতেমা বেগম।

দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহকর্মীর পরিচয়ের সীমা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়ার অন্তরঙ্গ সহচর। কারাগারের নিঃসঙ্গ প্রকোষ্ঠ, গৃহবন্দিত্বের দীর্ঘ দিন, হাসপাতালের নীরব রাত কিংবা বিদেশ সফরের শান্ত করিডর—সবখানেই নিঃশব্দ উপস্থিতি ছিল তার।

তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মী নন, কোনো দলীয় পদেও ছিলেন না। তবু ইতিহাসের কঠিন বাঁকে বাঁকে তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য।

দুঃখের ভেতর বড় হওয়া জীবন

ফাতেমার জন্ম ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রামে। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। সংসারের ভার তার কাঁধে আসে খুব অল্প বয়সেই।

একই ইউনিয়নের কৃষক মো. হারুন লাহাড়ির সঙ্গে বিয়ের পর সংসার বাঁধেন। মেঘনা নদীর চরে কৃষিকাজ করে চলতো জীবন। ঘরে আসে মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। ছেলের বয়স তখন মাত্র দুই বছর, ঠিক সেই সময়, ২০০৮ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার স্বামী। মুহূর্তে বদলে যায় জীবনের মানচিত্র।

স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট দুই সন্তান নিয়ে তিনি ফিরে যান বাবা-মায়ের ঘরে। মুদি দোকানি বাবার সামান্য আয় সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছিল না। তখনই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের গ্রামে রেখে কাজের খোঁজে ঢাকায় পাড়ি জমান।

ঢাকায় এসে নতুন অধ্যায়

২০০৯ সাল। পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি কাজ পান খালেদা জিয়ার বাসভবনে। সেখান থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ সহযাত্রা। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক নারীর দৈনন্দিন জীবনের নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠেন ফাতেমা।

বাথরুমে আনা–নেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, শারীরিক দুর্বলতায় হাত ধরে রাখা, এসব কাজ তার কাছে শুধু দায়িত্ব নয়, যেন সম্পর্কের দায়।

ফিরোজার দোরগোড়ায় যে দৃশ্যপট

২০১৪ সালের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’। গুলশানের বাসার সামনে বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে পথ রুদ্ধ। গাড়িতে উঠেও বেরোতে না পেরে ফিরোজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছেন খালেদা জিয়া। পুলিশের চাপে শরীরের ভার সামলাতে পারছেন না তিনি।

ঠিক তখন দৃশ্যপটে ফাতেমা, নীরবে শক্ত করে ধরে রেখেছেন তার হাত। ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে সেই মুহূর্ত। রাজনীতির উত্তাপের মাঝেও মানবিকতার এক স্থির ছবি।

কারাগারের ভেতরেও ফাতেমা

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যান। নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো জেলখানা। সেই সময় তার আইনজীবীরা আবেদন করেন গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম যেন তার সঙ্গে থাকতে পারেন।

আদালতের অনুমতিতে ছয় দিন পর ফাতেমা প্রবেশ করেন কারাগারে। রাজনৈতিক কোনো পরিচয় ছাড়াই স্বেচ্ছায় তিনি হয়ে ওঠেন কারাবন্দি। কারণ, তিনি জানতেন, এই সময়ে একা থাকা মানে ভেঙে পড়া।

হাসপাতাল, করোনা আর ভয়

২০২১ সালের এপ্রিল মাস। করোনা আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। ৫৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন তখন। যখন মানুষ প্রিয়জনের কাছেও যেতে ভয় পাচ্ছেন, তখন ফাতেমা ছিলেন অবিচল। সেবিকা হয়ে, সাহস হয়ে, ছায়া হয়ে ছিলেন খালেদা জিয়ার পাশে।

শেষ পর্যন্ত ছায়া

সর্বশেষ লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার সময়ও তার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। আগেও বিদেশ সফরে অনেকবার গেছেন। কোনো আলোচনায় নেই তার নাম। নেই কোনো বক্তব্য। তবু ইতিহাসের পাশে পাশে তার ছায়া পড়ে আছে।

ফাতেমা বেগম প্রমাণ করেছেন, সব সম্পর্ক ক্ষমতার নয়। কিছু সম্পর্ক শুধু দায়িত্ব আর মানবিকতার। রাজনীতির কোলাহলের ভিড়ে তিনি এক নীরব নাম। কিন্তু সেই নীরবতাই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।

জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপি মহাসচিবের সম্পদ ৪ কোটি টাকার, বার্ষিক আয় ১১ লাখ

খালেদা জিয়ার ছায়াসঙ্গী ছিলেন এই ফাতেমা

আপডেট সময় ০৯:০২:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন ফাতেমা। এক সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কটাক্ষ করে বলেছিলেন, কারাগারেও খালেদা জিয়ার ফাতেমাকে প্রয়োজন হবে।

রাজনীতির ইতিহাসে আলোচনায় আসে নেতা, আন্দোলন, ক্ষমতা কিংবা কারাবাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের আড়ালে থেকে যান কিছু নীরব মুখ—যারা আলোয় নয়, ছায়ায় থেকেই সময়ের সাক্ষী হন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এমন এক ছায়াসঙ্গীর নাম ফাতেমা বেগম।

দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহকর্মীর পরিচয়ের সীমা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়ার অন্তরঙ্গ সহচর। কারাগারের নিঃসঙ্গ প্রকোষ্ঠ, গৃহবন্দিত্বের দীর্ঘ দিন, হাসপাতালের নীরব রাত কিংবা বিদেশ সফরের শান্ত করিডর—সবখানেই নিঃশব্দ উপস্থিতি ছিল তার।

তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মী নন, কোনো দলীয় পদেও ছিলেন না। তবু ইতিহাসের কঠিন বাঁকে বাঁকে তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য।

দুঃখের ভেতর বড় হওয়া জীবন

ফাতেমার জন্ম ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রামে। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। সংসারের ভার তার কাঁধে আসে খুব অল্প বয়সেই।

একই ইউনিয়নের কৃষক মো. হারুন লাহাড়ির সঙ্গে বিয়ের পর সংসার বাঁধেন। মেঘনা নদীর চরে কৃষিকাজ করে চলতো জীবন। ঘরে আসে মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। ছেলের বয়স তখন মাত্র দুই বছর, ঠিক সেই সময়, ২০০৮ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার স্বামী। মুহূর্তে বদলে যায় জীবনের মানচিত্র।

স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট দুই সন্তান নিয়ে তিনি ফিরে যান বাবা-মায়ের ঘরে। মুদি দোকানি বাবার সামান্য আয় সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছিল না। তখনই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের গ্রামে রেখে কাজের খোঁজে ঢাকায় পাড়ি জমান।

ঢাকায় এসে নতুন অধ্যায়

২০০৯ সাল। পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি কাজ পান খালেদা জিয়ার বাসভবনে। সেখান থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ সহযাত্রা। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক নারীর দৈনন্দিন জীবনের নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠেন ফাতেমা।

বাথরুমে আনা–নেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, শারীরিক দুর্বলতায় হাত ধরে রাখা, এসব কাজ তার কাছে শুধু দায়িত্ব নয়, যেন সম্পর্কের দায়।

ফিরোজার দোরগোড়ায় যে দৃশ্যপট

২০১৪ সালের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’। গুলশানের বাসার সামনে বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে পথ রুদ্ধ। গাড়িতে উঠেও বেরোতে না পেরে ফিরোজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলছেন খালেদা জিয়া। পুলিশের চাপে শরীরের ভার সামলাতে পারছেন না তিনি।

ঠিক তখন দৃশ্যপটে ফাতেমা, নীরবে শক্ত করে ধরে রেখেছেন তার হাত। ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে সেই মুহূর্ত। রাজনীতির উত্তাপের মাঝেও মানবিকতার এক স্থির ছবি।

কারাগারের ভেতরেও ফাতেমা

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যান। নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো জেলখানা। সেই সময় তার আইনজীবীরা আবেদন করেন গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম যেন তার সঙ্গে থাকতে পারেন।

আদালতের অনুমতিতে ছয় দিন পর ফাতেমা প্রবেশ করেন কারাগারে। রাজনৈতিক কোনো পরিচয় ছাড়াই স্বেচ্ছায় তিনি হয়ে ওঠেন কারাবন্দি। কারণ, তিনি জানতেন, এই সময়ে একা থাকা মানে ভেঙে পড়া।

হাসপাতাল, করোনা আর ভয়

২০২১ সালের এপ্রিল মাস। করোনা আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। ৫৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন তখন। যখন মানুষ প্রিয়জনের কাছেও যেতে ভয় পাচ্ছেন, তখন ফাতেমা ছিলেন অবিচল। সেবিকা হয়ে, সাহস হয়ে, ছায়া হয়ে ছিলেন খালেদা জিয়ার পাশে।

শেষ পর্যন্ত ছায়া

সর্বশেষ লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার সময়ও তার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। আগেও বিদেশ সফরে অনেকবার গেছেন। কোনো আলোচনায় নেই তার নাম। নেই কোনো বক্তব্য। তবু ইতিহাসের পাশে পাশে তার ছায়া পড়ে আছে।

ফাতেমা বেগম প্রমাণ করেছেন, সব সম্পর্ক ক্ষমতার নয়। কিছু সম্পর্ক শুধু দায়িত্ব আর মানবিকতার। রাজনীতির কোলাহলের ভিড়ে তিনি এক নীরব নাম। কিন্তু সেই নীরবতাই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।