রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে শামদেশ বলতে যেসব অঞ্চলকে বোঝানো হতো তার মধ্যে অন্যতম ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। শামদেশ বলতে বোঝায়, বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। বিশেষ করে বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বেশকিছু ভবিষ্যদ্বাণী আছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, ভবিষ্যতে এ অঞ্চল পরিণত হবে মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটিতে। অতীতে এটি ছিল নবী ও রাসুলদের পবিত্র ভূমি।
কেয়ামতের পূর্বে এখানেই আসমান থেকে অবতরণ করবেন ঈসা (আ.)। দাজ্জালের অবসান ঘটবে এ ভূমিতেই এবং এখানেই ঘটবে কেয়ামতের নিষ্পত্তিমূলক মহাসংঘর্ষ। শামের ভূমি নিয়ে রাসুল (সা.) বহু ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বিশেষ করে বায়তুল মুকাদ্দাস ও আশপাশের অঞ্চল নিয়ে রয়েছে অসংখ্য হাদিস, যা ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিত দেয়। ফিলিস্তিন নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৭ ভবিষ্যদ্বাণী হলো-
১. সত্যবাদী দলের অবস্থানস্থল- রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, তার উম্মতের মধ্যে সব সময় একটি বিশেষ দল থাকবে, যারা সত্যের পথে অবিচল থাকবে এবং নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। আল্লাহর সহায়তা তাদের সঙ্গে থাকবে, এবং কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কেয়ামত পর্যন্ত তারা বিজয়ের অবস্থানে থাকবে। হাদিস অনুযায়ী, এ দলটির অবস্থান হবে শাম অঞ্চলে। মুগিরা ইবন শোবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের একটি দল সবসময় সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে, এমনকি কেয়ামত এসে যাবে আর তারা তখনো বিজয়ী থাকবে।’ (বুখারি : ৭৩১১)
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সবসময় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসিকতায় টিকে থাকবে এবং শত্রুরা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না—শুধু দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। এ অবস্থা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। সাহাবিরা তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, তারা কোথায় অবস্থান করবে?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তারা বায়তুল মাকদিস ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২৩২০)
২. মুসলিমদের দ্বিতীয় হিজরত ভূমি- সাধারণভাবে হিজরত বলতে বোঝায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদের মক্কা থেকে মদিনায় গমন। তবে এক হাদিসে ভবিষ্যতের এক বিশেষ হিজরতের কথাও বলা হয়েছে, যা সংঘটিত হবে শাম অঞ্চলে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি—‘প্রথম হিজরতের পর শিগগিরই আরেকটি হিজরত হবে। সে সময়ে দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতভূমি—শাম দেশে অবস্থান করবে। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে অধঃপতিত মানুষরা বাকি থাকবে, যাদের ভূমি তাদের ছুড়ে ফেলবে। আল্লাহ তাদের ঘৃণা করবেন এবং ফিতনার আগুন তাদের ঘিরে ধরবে, তারা যেখানে যাবে, সঙ্গে থাকবে বানর ও শূকরের মতো চরিত্র।’(আবু দাউদ : ২৪৮২)
৩. মুসলমানদের সেনাছাউনি- একসময় শাম অঞ্চল মুসলমানদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে এবং দামেস্ক শহরের পার্শ্ববর্তী গোতা নগরী তাদের সেনাছাউনি হবে। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহাযুদ্ধের সময় মুসলমানদের আশ্রয় হবে গোতা শহরে, যা দামেস্কের কাছে অবস্থিত। এটি শামের অন্যতম উৎকৃষ্ট শহর।’ (আবু দাউদ : ৪২৯৮)
একটি অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘অচিরেই তোমরা শাম জয় করবে, যখন সেখানে বসবাসের অধিকার পাবে। তোমরা দামেস্ক শহরকে বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করবে, কারণ এটি যুদ্ধকালে মুসলমানদের আশ্রয়স্থল হবে। তাদের ছাউনি হবে গোতা নামক একটি ভূমিতে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৪৭০)
৪. ইহুদিদের সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধ হবে- একটি হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না মুসলমানরা ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। মুসলমানরা তাদের হত্যা করবে এবং তখন তারা পাথর বা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে, ‘হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এখানে ইহুদি রয়েছে, আসো, তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ গাছ এ কথা বলবে না, কারণ এটি ইহুদিদের গাছ।’(সহিহ মুসলিম: ৭০৭৫)
৫. সত্যের পক্ষে বিজয়ীদের ভূমি হবে ফিলিস্তিন- বায়তুল মুকাদ্দাস বা ফিলিস্তিনকে মহানবী (সা.) একদিন বিজয়ীদের ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা ইহুদিদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটাবে। মুসলমানদের একটি দল তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে এবং বিজয়ী হবে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল সবসময় সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। তারা শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী থাকবে এবং দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধীপক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী, কেয়ামত পর্যন্ত তারা এমন অবস্থায় থাকবে। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় অবস্থান করবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তার আশপাশে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ : ২১২৮৬)
৬. ঈসা (আ.)-এর অবতরণস্থল ও দাজ্জালের মৃত্যুস্থান- ঈসা (আ.) বর্তমানে দ্বিতীয় আকাশে অবস্থান করছেন এবং কেয়ামতের পূর্বে তিনি আবার পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। তিনি দুই ফেরেশতার ডানায় ভর করে সিরিয়ার দামেস্ক শহরের একটি উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন। এরপর তিনি সিরিয়ার তবে লুদ নামক স্থানে গিয়ে দাজ্জালকে হত্যা করবেন।
নাওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার দাজ্জাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, তখন আল্লাহ ঈসা ইবন মারইয়ামকে প্রেরণ করবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার কাঁধে ভর করে, ওয়ারস ও জাফরান রংয়ের কাপড় পরিধান করে দামেস্ক নগরের পূর্ব দিকে উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন। তার মাথা থেকে ঘাম ঝরতে থাকবে এবং যেখানে তার শ্বাস যাবে, সেই জায়গায় কাফিরদের ধ্বংস হবে। তিনি দাজ্জালের খোঁজ করতে থাকবেন এবং অবশেষে সিরিয়ার লুদ স্থানে গিয়ে তাকে পাকড়াও করে হত্যা করবেন। (মুসলিম : ২৯৩৭)
৭. হাশরের ময়দান- আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনের ভূমিকে ‘হাশরের ভূমি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘তিনিই কিতাবের অধিকারীদের মধ্যে যারা কাফির, তাদের প্রথম সমাবেশে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন।’ (সুরা হাশর : ২) এখানে ‘প্রথম সমাবেশ’ দ্বারা শাম দেশে ইহুদিদের একত্রিত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে, যখন নবী (সা.) মদিনা থেকে বনু নাজিরকে নির্বাসিত করেছিলেন। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা-২৬২)
মায়মুনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বায়তুল মুকাদিস সম্পর্কে কিছু বলুন।’ রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বায়তুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান এবং পুনরুত্থানের স্থান। সেখানে গিয়ে নামাজ আদায় করো, কারণ সেখানে এক ওয়াক্ত নামাজ অন্য মসজিদে এক হাজার ওয়াক্ত নামাজের সমান।’ তিনি আর বলেন, যে ব্যক্তি সেখানে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে না, সে যেন সেখানে জ্বালানি তেল হাদিয়া হিসেবে পাঠায়, কারণ যে বায়তুল মুকাদিসে হাদিয়া পাঠায়, সে তাতে নামাজ আদায়কারীর মতো সওয়াব পাবে। (মুসনাদে আহমদ : ২৭৬২৬)