গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে অন্যতম জঘন্য অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনসহ বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ আইনে এ ধরনের অপরাধকে সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতিহাস জুড়ে বহু স্বৈরশাসক ও সরকারপ্রধান গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন; তাদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হন।
সোমবার বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মাধ্যমে সেই দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোশেভিচ, বসনিয়ার রাদোভান কারাদজিক এবং কঙ্গোর জোসেফ কাবিলার মতো নেতাদের পাশে নিজের নাম লেখালেন।
এ রায়ের মধ্য দিয়ে ২৩০ বছর পর আবার কোনো নারী সরকারপ্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। শেষবার এমনটি ঘটেছিল ১৭৯৩ সালে, যখন ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী রানি মারি এন্তনেতের গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করা হয়।
বাংলাদেশে গণহত্যার অভিযোগে সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটাই প্রথম রায়। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আর সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় পাচ্ছেন পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ
তাঁর বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দু—২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও পদ্ধতিগত দমন–পীড়নের নির্দেশ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং দলীয় সহযোগী সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে গণহত্যা, খুন ও নির্যাতন সংঘটনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে। এ অভিযানে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ২৫ হাজারের বেশি আহত ও নির্যাতিত হন বলে অভিযোগে বলা হয়।
বিশ্বজুড়ে গণহত্যা–অভিযুক্ত সরকারপ্রধানরা
সাদ্দাম হোসেন (ইরাক)
২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৮২ সালে ১৪৮ জন শিয়া হত্যার দায়ে ইরাকি আদালতে মৃত্যুদণ্ড পান। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকর হয়।
কিম জং ইল (উত্তর কোরিয়া)
আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়নি; তবে জাতিসংঘসহ বহু মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে তাঁর আমলে পদ্ধতিগত নিপীড়ন, উপনিবেশ–শিবির এবং দুর্ভিক্ষকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০১১ সালে হৃদরোগে মৃত্যু।
পল পট (কম্বোডিয়া)
১৯৭৫-৭৯ সালে খেমাররুজ শাসনে ১৭–২২ লক্ষ মানুষ নিহত। ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার অন্যতম। বিচার শুরুর আগেই ১৯৯৮ সালে গৃহবন্দি অবস্থায় মৃত্যু।
স্লোবোদান মিলোশেভিচ (সার্বিয়া)
বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোয় গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার চলাকালে ২০০6 সালে কারাগারে মৃত্যু।
ওমর আল-বশির (সুদান)
দারফুর গণহত্যায় অভিযুক্ত। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ২০১৯ সালে দায়িত্বচ্যুত হয়ে দোষী সাব্যস্ত; বয়স বিবেচনায় সংশোধনাগারে রাখা হয়।
হিসেন হাব্রে (চাদ)
১৯৮২–১৯৯০ সালের শাসনে ৪০ হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ। আফ্রিকান বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ২০১৬ সালে যাবজ্জীবন দণ্ড।
রাদোভান কারাদজিক (বসনিয়া)
১৯৯৫ সালের স্রেব্রেনিৎসায় ৮,০০০ মুসলমান হত্যায় মূল ভূমিকা। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ড।
জোসেফ কাবিলা (ডিআর কঙ্গো)
২০২১ সালে সামরিক আদালত অনুপস্থিতিতে দেশদ্রোহিতা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
দেশে দেশে সরকারপ্রধানদের মৃত্যুদণ্ড
ইয়ন আন্তোনেস্কু (রোমানিয়া)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন স্বৈরশাসক। ১৯৪৬ সালে মৃত্যুদণ্ড।
নিকোলাই চাউসেস্কু (রোমানিয়া)
২৪ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন শেষে ১৯৮৯ সালে বিপ্লবের সময় স্ত্রীসহ গুলি করে হত্যা।
জুলফিকার আলি ভুট্টো (পাকিস্তান)
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে জিয়া সরকার তাকে ১৯৭৯ সালে ফাঁসি দেয়।
ষোড়শ লুই (ফ্রান্স)
ফরাসি বিপ্লবে ১৭৯৩ সালে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড।
মারি এন্তনে
অঢেল খরচ ও রাজকীয় অপচয়ের দায়ে জনগণের ক্রোধের মুখে ১৭৯৩ সালে গিলোটিনে শিরশ্ছেদ।
প্রথম চার্লস (ইংল্যান্ড)
গৃহযুদ্ধ পর্বে দেশদ্রোহের অভিযোগে ১৬৪৯ সালে কুঠারাঘাতে মৃত্যুদণ্ড।
অ্যান বলিন (ইংল্যান্ড)
অষ্টম হেনরির স্ত্রী; অভিযোগ ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ১৫৩৬ সালে শিরশ্ছেদ।
আদনান মেন্দারেস (তুরkiye)
১৯৬০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান লঙ্ঘন, গণহত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৬১ সালে ফাঁসি।
মোহাম্মদ মুরসি (মিসর)
২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেও রায় কার্যকর হওয়ার আগেই ২০১৯ সালে আদালতে শুনানির সময় মৃত্যু।


























