ঢাকা ১১:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কেন ইসরাইল এত ভারতীয় চায়? ভিতরের কারণ জানলে চমকে যাবেন!

‘আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।’—এভাবে নিজের হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন ইসরাইলের তেল আবিবে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক রাঘবেন্দ্র নাইক। পেশায় একজন কেয়ারগিভার, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বাসিন্দা তিনি। কাজের সূত্রে গত ১৩ বছর ধরে ইসরাইলে অবস্থান করছেন। তবে ইরান-ইসরাইল চলমান সংঘাতে তিনি যেমন দুশ্চিন্তায়, তেমনি অনিশ্চয়তার মুখে আটকে আছেন আরও হাজারো ভারতীয়।

ইসরাইল ও ইরানের সাম্প্রতিক সংঘাতে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে দেশটিতে অবস্থানরত ভারতীয়দের একটি বড় অংশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই দেশে ফিরবেন। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি রাত তাঁদের কাছে একেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি। কারণ সাইরেন বাজলেই তাদের ছুটতে হয় বোমা হামলা থেকে বাঁচার জন্য ভূগর্ভস্থ শেল্টারে।

তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশন অব ইসরাইলের সভাপতি সোমা রভিও একই রকম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তিনি জানান, ‘গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব পরিকল্পনা অনিশ্চিত।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরাইলে অবস্থান করছেন। তবে বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই মনে করা হয়। শুধু ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্তই ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় নাগরিক ইসরাইলে বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বলে সরকারি তথ্য বলছে।

বর্তমানে প্রায় ১৯৫টি ইসরাইলি কোম্পানিতে ভারতীয়রা নিযুক্ত আছেন। তারা মূলত দুটি খাতে কাজ করেন—স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাত।

ইন্ডিয়ান ইকোনমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবালের মতে, ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি চাহিদা কেয়ার গিভার বা নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। প্রবীণ ইসরাইলিদের দেখভাল করার জন্য ভারতীয়রা কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। এরা মূলত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, যাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে আসেন।

নির্মাণ খাতেও ভারতীয়দের চাহিদা বাড়ছে। ভবন নির্মাণ, প্লাস্টারিং, রড বাঁকানোসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে অনেক ভারতীয় বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন।

ম্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, “ইসরাইলে বেতন ভালো, স্বাস্থ্যবিমা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত। যুদ্ধের ভয় থাকলেও এখানকার সরকারি সুযোগ-সুবিধা অন্য দেশের তুলনায় বেশি। আমাদের উপার্জনের উপর ভারতে থাকা পরিবার নির্ভর করে।”

ইসরাইল-ইরান উত্তেজনার জেরে ইতোমধ্যেই ভারত সরকার সম্ভাব্য উদ্ধারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসরাইল থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে প্রথমে তাদের স্থলপথে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস পুরো বিষয়টি তদারকি করছে।

ইসরাইলে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের জীবনও এই সংঘাতে পাল্টে যাচ্ছে। দেশটির সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, মেয়েদেরও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। এমনই একজন তরুণী স্তাভ, যিনি দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে দায়িত্ব শেষ করে ফিরেছেন, জানাচ্ছেন—‘আমাকে হয়তো আবার সেনাবাহিনীতে যেতে হতে পারে।’

একদিকে ভালো বেতন ও সুযোগের দেশ ইসরাইল, অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইরেনের আতঙ্ক। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার ভারতীয় কর্মী। রাঘবেন্দ্র নাইকের কণ্ঠেই যেন উঠে আসে সবার মনোভাব—
“আগে বছরে অন্তত একবার দেশে যেতে পারতাম। এখন তো সবই অনিশ্চিত। এখন শুধু ভয় হয়—ফিরতে পারব তো?”

জনপ্রিয় সংবাদ

ইসরাইলি হামলায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কা, প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান

কেন ইসরাইল এত ভারতীয় চায়? ভিতরের কারণ জানলে চমকে যাবেন!

আপডেট সময় ১২:০৮:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

‘আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। ভেবেছিলাম সামনের মাসে বাড়ি যাব। কিন্তু ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে গেল। কবে যেতে পারব জানি না।’—এভাবে নিজের হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন ইসরাইলের তেল আবিবে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক রাঘবেন্দ্র নাইক। পেশায় একজন কেয়ারগিভার, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বাসিন্দা তিনি। কাজের সূত্রে গত ১৩ বছর ধরে ইসরাইলে অবস্থান করছেন। তবে ইরান-ইসরাইল চলমান সংঘাতে তিনি যেমন দুশ্চিন্তায়, তেমনি অনিশ্চয়তার মুখে আটকে আছেন আরও হাজারো ভারতীয়।

ইসরাইল ও ইরানের সাম্প্রতিক সংঘাতে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে দেশটিতে অবস্থানরত ভারতীয়দের একটি বড় অংশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই দেশে ফিরবেন। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি রাত তাঁদের কাছে একেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি। কারণ সাইরেন বাজলেই তাদের ছুটতে হয় বোমা হামলা থেকে বাঁচার জন্য ভূগর্ভস্থ শেল্টারে।

তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশন অব ইসরাইলের সভাপতি সোমা রভিও একই রকম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তিনি জানান, ‘গত সপ্তাহে আমার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে এসেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব পরিকল্পনা অনিশ্চিত।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আনুমানিক ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরাইলে অবস্থান করছেন। তবে বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই মনে করা হয়। শুধু ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্তই ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় নাগরিক ইসরাইলে বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বলে সরকারি তথ্য বলছে।

বর্তমানে প্রায় ১৯৫টি ইসরাইলি কোম্পানিতে ভারতীয়রা নিযুক্ত আছেন। তারা মূলত দুটি খাতে কাজ করেন—স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাত।

ইন্ডিয়ান ইকোনমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ড. আসিফ ইকবালের মতে, ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি চাহিদা কেয়ার গিভার বা নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। প্রবীণ ইসরাইলিদের দেখভাল করার জন্য ভারতীয়রা কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। এরা মূলত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, যাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে আসেন।

নির্মাণ খাতেও ভারতীয়দের চাহিদা বাড়ছে। ভবন নির্মাণ, প্লাস্টারিং, রড বাঁকানোসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজে অনেক ভারতীয় বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন।

ম্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা পিএন লরেন্স বলেন, “ইসরাইলে বেতন ভালো, স্বাস্থ্যবিমা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত। যুদ্ধের ভয় থাকলেও এখানকার সরকারি সুযোগ-সুবিধা অন্য দেশের তুলনায় বেশি। আমাদের উপার্জনের উপর ভারতে থাকা পরিবার নির্ভর করে।”

ইসরাইল-ইরান উত্তেজনার জেরে ইতোমধ্যেই ভারত সরকার সম্ভাব্য উদ্ধারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসরাইল থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে প্রথমে তাদের স্থলপথে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস পুরো বিষয়টি তদারকি করছে।

ইসরাইলে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের জীবনও এই সংঘাতে পাল্টে যাচ্ছে। দেশটির সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, মেয়েদেরও বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। এমনই একজন তরুণী স্তাভ, যিনি দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে দায়িত্ব শেষ করে ফিরেছেন, জানাচ্ছেন—‘আমাকে হয়তো আবার সেনাবাহিনীতে যেতে হতে পারে।’

একদিকে ভালো বেতন ও সুযোগের দেশ ইসরাইল, অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইরেনের আতঙ্ক। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার ভারতীয় কর্মী। রাঘবেন্দ্র নাইকের কণ্ঠেই যেন উঠে আসে সবার মনোভাব—
“আগে বছরে অন্তত একবার দেশে যেতে পারতাম। এখন তো সবই অনিশ্চিত। এখন শুধু ভয় হয়—ফিরতে পারব তো?”