প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরই গান গাওয়া শুরু করেন বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজ ওরফে আবুল বয়াতি। বয়স মাত্র ১০, তখন থেকেই বাউল গানের দুনিয়ায় পদচারণা। কিন্তু কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হয় ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দেওয়া—যা সময়ের সঙ্গে রূপ নেয় কোরআনের ভুয়া তাফসিরকারকের ভূমিকায়।
গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন আসরে নিজেকে ‘তাফসিরকারক’ দাবি করে ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে আসছিলেন নানা বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা। সম্প্রতি একটি পালাগানের আসরে আল্লাহ, কোরআন ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যা শেষ পর্যন্ত তার গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে থামে।
বর্তমানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় কারাগারে রয়েছেন আবুল বয়াতি।
ভিআইপি ভক্ত, রহস্যময় জীবন, ক্ষমতাসীনদের ছায়া
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার চর দিল্লি তার গ্রামের বাড়ি—যেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন নানা ‘ভিআইপি’ ভক্ত। সেখানে বসত আড্ডা, আসর, আর বিতর্কিত বক্তব্য। স্থানীয়দের অভিযোগ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, এবং জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেত না।
দুই সন্তানের জনক আবুল গান গাওয়ার প্রতিটি আসরেই সঙ্গে রাখতেন স্ত্রী আলেয়া বেগম, যিনি নিজেও বাউলশিল্পী।
পরে নিজেকে পীর হিসেবে পরিচিত করতে শুরু করেন এবং দাবি করেন—২০০৭ সালে পীর সৈয়দ হাসিব আল হাসান রেজুইয়ের কাছ থেকে খেলাফত পেয়েছেন। এমনকি নিজের নামও লেখেন—
“সৈয়দে গোলাম মহারাজ আবুল সরকার আল চিশতী নিজামি”।
তার দাবি—দেশজুড়ে তার ভক্ত ৫০ হাজার, শিষ্য হাজারখানেক। ভারত সফর, আজমির শরিফ ভ্রমণ, ওমরা পালন—এসব কথাও ভক্তদের কাছে প্রচার করেছেন তিনি।
জমি দখল, পারিবারিক নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ
গ্রামবাসী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—জমিজমা দখল, জাদুটোনা অভিযোগ, প্রভাব খাটানো—এসব নিয়ে তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে।
- আবুলের নিজের আছে প্রায় ৪৫ শতাংশ বসতভিটা, আরও ২০০ শতাংশ কেনা জমি, নবীনগরে একটি প্লট, আরিচা-দৌলতদিয়া ঘাটে ব্যবসা, এবং মিরপুরে ভাড়া বাসা।
- ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম, যিনি মসজিদের ইমাম, তার সঙ্গে ধর্মবিষয়ক মতবিরোধের কারণে দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব চলছিল।
- জাহাঙ্গীরকে জামায়াত–শিবির তকমা দিয়ে মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠানো,
- তার পরিচালিত মহিলা মাদরাসা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে বন্ধ করানো,
- বাবার ৬১ শতাংশ জমির মধ্যে ৪৫ শতাংশ জাদুটোনার ভয় দেখিয়ে লিখে নেওয়ার অভিযোগ
—সবই স্বজনদের মুখে পাওয়া তথ্য।
এমনকি জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন ৪ শতাংশ জমি দখল এবং পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘর ভেঙে পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও স্থানীয়দের স্মরণে রয়েছে।
এর পর থেকেই তার গায়ে অদ্ভুত চুলকানি শুরু হয়, যা সিঙ্গাপুর পর্যন্ত চিকিৎসায়ও সারে না—শেষ পর্যন্ত প্রায় কাফনের মতো সাদা কাপড় পরে চলাফেরা শুরু করেন তিনি।
ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে চাটুকারিতা, ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তির অভিযোগ
আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন আসরে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও স্থানীয় নেতাদের উদ্দেশে চাটুকারিতা করে গান গেয়ে তাদের খুশি রাখতেন।
অধিকাংশ সময় ধর্মীয় জ্ঞানের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতেন, যা বারবার বিতর্ক সৃষ্টি করে।
পুলিশ এখন খতিয়ে দেখছে—দেশ শান্ত থাকা অবস্থায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন কি না।
‘পীর সাজার’ আসল কারণ—টাকা!
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন—নতুন পীর হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল অতিরিক্ত অর্থ রোজগার করা।
অসংখ্য বাউল ভক্ত থাকলেও পীর দাবি করার পর সেই জনপ্রিয়তা ফিরে পাননি।
ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক জানিয়েছেন, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মানিকগঞ্জে বাউলদের ওপর হামলা—২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কারাবন্দি আবুল বয়াতির মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে যোগ দিতে আসা বাউলদের ওপর হামলার অভিযোগে ২০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের প্রস্তুতিকালে ‘তৌহিদি জনতা’ ব্যানারের কিছু লোক তাদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ।
এ ঘটনায় আহত বাউলশিল্পী জহিরুল ইসলামের বাবা আলাউদ্দিন ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলা করেন।
এর আগে ৪ নভেম্বর ঘিওরে পালাগানের আসরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে আবুলের বিরুদ্ধে।
২০ নভেম্বর তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে, এবং দুই দফা জামিন আবেদন আদালত নামঞ্জুর করে।
দেশজুড়ে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।























