দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ইন্তেকাল করেন। মাতৃভূমির মুক্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে তিনি শহীদের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন হন।
২০২৪ সালের আগস্টে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার আলোকে বাংলাদেশ পরিচালনার স্বপ্ন নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চ। তরুণ সমাজকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে গড়ে তোলেন ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার, যা অল্প সময়েই প্রতিবাদী তরুণদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
পরিচয় ও পারিবারিক পটভূমি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ‘শরিফ ওসমান হাদি’ নামে পরিচিতি পেলেও তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ওসমান গনি। এর আগে তিনি ‘সীমান্ত শরিফ’ নামে কবিতা লিখতেন। প্রয়াত পিতা মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদির নামানুসারেই তিনি নিজেকে শরিফ ওসমান হাদি হিসেবে পরিচিত করেন।
শিক্ষক পরিবারের সন্তান হাদির গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি পৌরসভার খাসমহল এলাকায়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর পিতা নলছিটি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ও খাসমহল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ছিলেন। মাতা তাসলিমা হাদি একজন গৃহিণী। পরিবারের আরও তিনজন সদস্য শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত।
ছয় ভাই-বোনের মধ্যে বড় ভাই (ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়) ড. আবু বকর ছিদ্দিক বরিশালের বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদের খতিব। চতুর্থ ভাই-বোন মাছুমা নলছিটি ইসলামি সিনিয়র মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক। ভাই ওমর বিন হাদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে সুগন্ধা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বড় বোন ফাতেমা বেগম ও তৃতীয় বোন ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী।
ব্যক্তিগত জীবনে হাদি ছিলেন এক সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া ইসলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। তাঁদের ৯ মাস বয়সী এক পুত্রসন্তান রয়েছে।
শিক্ষা ও পেশাগত জীবন
শরিফ ওসমান হাদি ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে ৩.৪৯ এবং মাস্টার্সে ৩.৫২ সিজিপিএ অর্জন করে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও মেধার স্বাক্ষর রাখেন হাদি। ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিলে জিপিএ ৪.৭৫ এবং আলিমে জিপিএ–৫ অর্জন করেন তিনি।
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজধানীর বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে কিছুদিন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকতা করেন হাদি। পাশাপাশি দীর্ঘদিন সাইফুর’স কোচিংয়ে সিনিয়র আইইএলটিএস ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে সেখানে যোগ দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হয়েও ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় তাঁর দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান
পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন দক্ষ বিতার্কিক ও আবৃত্তিকার। আবৃত্তি, বিতর্ক ও উপস্থিত বক্তৃতায় একাধিকবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। সংস্কৃতি ও রাজনীতির সমন্বয়ে একটি প্রতিবাদী প্রজন্ম গড়ে তোলাই ছিল তাঁর আজীবনের লক্ষ্য।
শরিফ ওসমান হাদির শাহাদাত কেবল একজন মানুষের মৃত্যু নয়; এটি একটি আদর্শের রক্তাক্ত সাক্ষ্য। তাঁর স্বপ্ন, সংগ্রাম ও আদর্শই আজ আন্দোলনরত তরুণদের পথনির্দেশক হয়ে উঠেছে।




















