কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। আর শীত মানেই গ্রামবাংলায় খেজুরের রস, গুড় আর পিঠাপুলি—যা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীতের সকালে তাজা খেজুর রস, রসের পিঠা কিংবা গুড়-মুড়ির সেই চিরচেনা দৃশ্য এখনও দেখা যায় নড়াইলের বিভিন্ন অঞ্চলে। শীত এলেই জেলার সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার গাছিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার ও রস সংগ্রহের কাজে। তবে দিন দিন কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা, ফলে কমে যাচ্ছে রস ও গুড় উৎপাদনও।
সদর উপজেলার গাছি কবীর মোল্যা জানান, শীতের শুরুতেই তারা গাছের মাথা পরিষ্কারে ব্যস্ত সময় কাটান। এক সপ্তাহ পর গাছে টিলে পাতা হয় এবং রস সংগ্রহ শুরু হয়। তিনি বলেন, “আমি রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করি। প্রতি কেজি গুড় ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। নড়াইলে রস ও গুড়ের চাহিদা অনেক বেশি হলেও উৎপাদন সেই তুলনায় কম।”
শেখহাটি গ্রামের গাছি শফিকুল ইসলামও একই কথা বলেন। তার মতে, তুলারামপুর, শেখহাটি, বেনহাটি, মুলিয়া, আগদিয়া এলাকায় রস কেনার জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু গাছ কমে যাওয়ায় চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
লোহাগড়া উপজেলার গাছি নজরুল শেখ ও মশিয়ার শেখ জানান, তারা প্রতিবছর শীত আসলেই খেজুর গাছ কাটার কাজ করেন। নিজের গাছের পাশাপাশি অন্যের গাছ কাটলেও উপার্জন হয় ভালোই।
স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল বিশ্বাস বলেন, “শীতকালে খেজুরের রস না হলে পিঠা-পায়েসে আনন্দই লাগে না। রস ছাড়া শীত যেন অপূর্ণ।”
এদিকে কালিয়া উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং অভিজ্ঞ গাছির অভাবে রস সংগ্রহ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় সাংবাদিক মো. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী রাজশাহী থেকে তিনজন অভিজ্ঞ গাছি এনে এলাকাবাসীকে উৎসাহিত করছেন। তাদের প্রচেষ্টায় মহাজন গ্রাম ও কাঠাদুরা এলাকায় প্রায় ২০০ খেজুর গাছ থেকে রস আসতে শুরু করেছে।
রাজশাহীর গাছি আজিজুর রহমান জানান, সাংবাদিক খাইরুলের উদ্যোগেই তারা নড়াগাতী থানার বিভিন্ন গ্রামে কাজ শুরু করেছেন। তাদের লক্ষ্য—মানুষকে খাঁটি খেজুর রস ও গুড়ের স্বাদ ফিরিয়ে দেওয়া।
গাছ মালিক আলেক ইসলাম বলেন, “গাছির অভাবে আগে গাছ কাটানোই যেত না। এখন আবার রস খেতে পারছি, গাছ থেকে আয়ও হচ্ছে।”
কাঠাদুরা গ্রামের মেহেদি হাসান তুষার বলেন, “একসময় কালিয়া খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন গাছ যেমন কমে গেছে, তেমনি গাছিও নেই। খাইরুল ভাইয়ের উদ্যোগে আবার আশার আলো দেখা যাচ্ছে।”
সাংবাদিক খাইরুল চৌধুরী জানান, শৈশবে খেজুর রস-গুড়ের পিঠা খাওয়ার স্মৃতি থেকেই তার এই উদ্যোগ। ভবিষ্যতে নতুন চারা রোপণসহ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে ২৩ হাজার ৫৫০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে ৩৫৪ মেট্রিক টন রস এবং ৫৩ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গাছিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ রস সংগ্রহেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা রস সংগ্রহে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন।
























