ঢাকা ০৩:২০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংবিধানের শুরুতেই ‘বিসমিল্লা’ বিতর্ক: পঞ্চদশ সংশোধনীর আইনি গলদ

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ১০:৪০:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৫৭৫ বার পড়া হয়েছে

বাংলার প্রবাদে বলা হয়—‘বিসমিল্লায় গলদ’, অর্থাৎ কোনো ভালো কাজের আরম্ভেই যদি ভুল থেকে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে এমনই একটি মৌলিক ত্রুটি বসে আছে পঞ্চদশ সংশোধনীর ভেতর। আর এই ত্রুটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—সংবিধানের প্রারম্ভে যুক্ত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এর বিষয়টি।

১. পঞ্চদশ সংশোধনী আর ‘বিসমিল্লা’র উৎস

২০১১ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক-দর্শনভিত্তিক বিভিন্ন বিষয় সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায় এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বড় অংশকেই ‘সংশোধন-অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয় (অনুচ্ছেদ ৭খ)।
কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার শুরুতেই বড় একটি ভুল রয়ে যায়—‘বিসমিল্লা’র সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে।

মূল ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ছিল না
এটি প্রথম যুক্ত হয় ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সামরিক আদেশের মাধ্যমে। পরের বছর অন্য একটি ঘোষণা আদেশে এর বাংলা রূপ যোগ হয়। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনী এই দুটি আদেশসহ জিয়ার আমলের বহু সামরিক কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়।

কিন্তু ২০০৬ সালের ‘মুন সিনেমা’ মামলার রায়ে হাইকোর্ট—এবং ২০১০ সালে আপিল বিভাগ—এই ঘোষণা আদেশ ও পঞ্চম সংশোধনীকে শুরু থেকেই বাতিল (void ab initio) ঘোষণা করে। আদালত স্পষ্টই বলে দেয়—এই আদেশগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই (non est)
ফলে ‘বিসমিল্লা’ও সাংবিধানিকভাবে অস্তিত্ব হারায়।

এখানেই মূল সমস্যার উদ্ভব।

২. যেটা নেই—সেটাই সংশোধন!

পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২ ধারায় সংবিধানের প্রারম্ভে থাকা ‘বিসমিল্লা’র বাক্যাংশটি প্রতিস্থাপন (substitution) করা হয়।
অর্থাৎ, আদালতের রায়ে যে বাক্যাংশটি শুরু থেকেই অবৈধ ও অস্তিত্বহীন—সেটিকেই আবার সংশোধন করে নতুন রূপে প্রতিস্থাপন করা হলো।

আইনগতভাবে এটি এক ধরনের বৈপরীত্য ও খারাপ ড্রাফটিংয়ের উদাহরণ, কারণ:

  • যে বিষয়টি শুরু থেকেই ‘non est’, তাকে প্রতিস্থাপন করা যায় না।
  • সংবিধানে নতুন শব্দ যুক্ত করতে হলে insertion বা inclusion ব্যবহার করতে হয়, substitution নয়।
    এটাই বাংলাদেশের সংবিধানের ‘বিসমিল্লায় গলদ’।

৩. গলদ উপেক্ষিতই রয়ে গেল

যদিও পঞ্চদশ সংশোধনীতে জিয়ার আমলের সামরিক আদেশগুলোকে পুরোপুরি অকার্যকর ধরে নিয়ে নতুনভাবে সংবিধান সাজানো হয়—তবুও ‘বিসমিল্লা’র বিষয়টি সেই ধারাবাহিকতায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
আদালত যাকে মওকুফ করেনি, যার অস্তিত্ব শুরু থেকেই শূন্য—তা সত্ত্বেও সেটির ‘প্রতিস্থাপন’ বজায় আছে বর্তমান সংবিধানে।

সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’-এও এই ত্রুটি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, যদিও দলগুলো সংবিধান সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।


লেখক: আইনবিষয়ক গবেষক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
(বর্তমানে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল)


 

জনপ্রিয় সংবাদ

শাজাহান খানের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পাহারায় যুবদল নেতা

সংবিধানের শুরুতেই ‘বিসমিল্লা’ বিতর্ক: পঞ্চদশ সংশোধনীর আইনি গলদ

আপডেট সময় ১০:৪০:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলার প্রবাদে বলা হয়—‘বিসমিল্লায় গলদ’, অর্থাৎ কোনো ভালো কাজের আরম্ভেই যদি ভুল থেকে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে এমনই একটি মৌলিক ত্রুটি বসে আছে পঞ্চদশ সংশোধনীর ভেতর। আর এই ত্রুটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—সংবিধানের প্রারম্ভে যুক্ত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এর বিষয়টি।

১. পঞ্চদশ সংশোধনী আর ‘বিসমিল্লা’র উৎস

২০১১ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক-দর্শনভিত্তিক বিভিন্ন বিষয় সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায় এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বড় অংশকেই ‘সংশোধন-অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয় (অনুচ্ছেদ ৭খ)।
কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার শুরুতেই বড় একটি ভুল রয়ে যায়—‘বিসমিল্লা’র সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে।

মূল ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ছিল না
এটি প্রথম যুক্ত হয় ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সামরিক আদেশের মাধ্যমে। পরের বছর অন্য একটি ঘোষণা আদেশে এর বাংলা রূপ যোগ হয়। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনী এই দুটি আদেশসহ জিয়ার আমলের বহু সামরিক কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়।

কিন্তু ২০০৬ সালের ‘মুন সিনেমা’ মামলার রায়ে হাইকোর্ট—এবং ২০১০ সালে আপিল বিভাগ—এই ঘোষণা আদেশ ও পঞ্চম সংশোধনীকে শুরু থেকেই বাতিল (void ab initio) ঘোষণা করে। আদালত স্পষ্টই বলে দেয়—এই আদেশগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই (non est)
ফলে ‘বিসমিল্লা’ও সাংবিধানিকভাবে অস্তিত্ব হারায়।

এখানেই মূল সমস্যার উদ্ভব।

২. যেটা নেই—সেটাই সংশোধন!

পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২ ধারায় সংবিধানের প্রারম্ভে থাকা ‘বিসমিল্লা’র বাক্যাংশটি প্রতিস্থাপন (substitution) করা হয়।
অর্থাৎ, আদালতের রায়ে যে বাক্যাংশটি শুরু থেকেই অবৈধ ও অস্তিত্বহীন—সেটিকেই আবার সংশোধন করে নতুন রূপে প্রতিস্থাপন করা হলো।

আইনগতভাবে এটি এক ধরনের বৈপরীত্য ও খারাপ ড্রাফটিংয়ের উদাহরণ, কারণ:

  • যে বিষয়টি শুরু থেকেই ‘non est’, তাকে প্রতিস্থাপন করা যায় না।
  • সংবিধানে নতুন শব্দ যুক্ত করতে হলে insertion বা inclusion ব্যবহার করতে হয়, substitution নয়।
    এটাই বাংলাদেশের সংবিধানের ‘বিসমিল্লায় গলদ’।

৩. গলদ উপেক্ষিতই রয়ে গেল

যদিও পঞ্চদশ সংশোধনীতে জিয়ার আমলের সামরিক আদেশগুলোকে পুরোপুরি অকার্যকর ধরে নিয়ে নতুনভাবে সংবিধান সাজানো হয়—তবুও ‘বিসমিল্লা’র বিষয়টি সেই ধারাবাহিকতায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
আদালত যাকে মওকুফ করেনি, যার অস্তিত্ব শুরু থেকেই শূন্য—তা সত্ত্বেও সেটির ‘প্রতিস্থাপন’ বজায় আছে বর্তমান সংবিধানে।

সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’-এও এই ত্রুটি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, যদিও দলগুলো সংবিধান সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।


লেখক: আইনবিষয়ক গবেষক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
(বর্তমানে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল)