বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতায় খালেদা জিয়ার অবদানগুলোও তুলা ধরা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। মূলত বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দেশের রাজনীতিতে ছিলেন যেমন আপোসহীন, তেমনি নানা সিদ্ধান্তে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছেন জোর দিয়ে। ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন, গঙ্গার পানি, ট্রানজিট, প্রতিরক্ষা– সব ইস্যুতেই তিনি নিয়েছিলেন কঠোর অবস্থান। আর এর প্রভাব ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও পড়েছিল গভীরভাবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ছোটবেলায় তাকে আদর করে ‘পুতুল’ বলে ডাকা হতো। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার তখন চা-ব্যবসায়ী, মূল বাড়ি ছিল ফেনীতে। আর মা তায়্যেবা ছিলেন বর্তমান ভারতের উত্তর দিনাজপুরের চাঁদবাড়ির সন্তান। দেশভাগের পর তার পরিবার চলে আসে দিনাজপুরে এবং এটি পরে স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হয়।
ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমের দাবি, ব্রিটিশ ভারতে জন্ম হলেও খালেদা জিয়ার রাজনীতির ভিত্তি দাঁড়ায় ‘ভারতবিরোধী’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করার পর তার নামের সঙ্গে ‘জিয়া’ নাম যুক্ত হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হলে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তিনি ফার্স্ট লেডির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ড তার জীবনে বড় মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি বিএনপিকে সংগঠিত করে জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হিসেবে দাঁড় করান।
ইন্ডিয়া টুডে বলছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদেই তিনি ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। এর মাধ্যমে ভারতের চেয়ে চীন ও ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতায় জোর দেন তিনি। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গঙ্গার পানি না পাওয়ার অভিযোগ তুলে বিষয়টি জাতিসংঘ ও ইসলামি দেশগুলোর সামনে তুলে ধরে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিরও চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। মূলত কলকাতা বন্দরে পানি সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে হুগলি নদীতে গঙ্গার পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয় ভারত।
ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমের দাবি, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টান আরও বাড়ে। জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি সেসময় সরকার গঠন করে। তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহারের অভিযোগ তোলে দিল্লি। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া ফেনীর এক সমাবেশে উলফা এবং এনএসসির মতো সংগঠনকে ‘স্বাধীনতাকামী’ আখ্যা দিয়ে বলেন— স্বাধীনতার জন্য যারা লড়ছে, তাদের প্রতি সমর্থন রয়েছে। এ সময় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে ট্যাংক, ফ্রিগেটসহ সামরিক সরঞ্জামের প্রধান জোগানদাতা হিসেবে বেইজিংকে বেছে নেয়া হয়।
এছাড়া ভারতের সঙ্গে স্থলপথে ট্রানজিট ও সংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার মতে, বিনা টোলের ট্রাক চলাচল দেশের জন্য ‘দাসত্বের’ সমান। তাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ভারতীয় পরিবহনের যাতায়াতে তথা বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান খালেদা জিয়া। তিনি মনে করেছিলেন, এই অনুমতি দেয়া হয়ে দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
এছাড়া ১৯৯২ সালের মে মাসে নয়াদিল্লি সফরে তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে মুখের ওপরই কড়া জবাব দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার সেই সফরের সময় নরসিমা রাও অভিযোগ করেন, বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীরা ভারতে ঢুকছে। জবাবে খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বলেন, ভারতের বাঙালিরা বাংলা বোঝেন, (বাংলায়) কথা বলেন— এতে তাদের সবাইকে বাংলাদেশি ভাবা যায় না।
ভারতীয় লেখক পুনম পান্ডের ‘ইন্ডিয়া–বাংলাদেশ ডোমেস্টিক পলিটিক্স’ বইয়ে খালেদা জিয়া ও নরসিমা রাওয়ের এই কথোপকথন নথিভুক্ত আছে।




















