ব্যাংক খাতে চলমান সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের একের পর এক নেতিবাচক বক্তব্য আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ‘জালিয়াতি ও লুটপাটে দেশের ১০টি ব্যাংক দেউলিয়ার পথে’, এমন মন্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন গ্রাহকেরা। অনেকে ব্যাংক থেকে গচ্ছিত টাকা উত্তোলনের জন্য ভিড় করছেন, ব্যাংকের বুথ ও শাখায় দেখা দিচ্ছে নগদ টাকার সংকট।
গভর্নরের মন্তব্যে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিক সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনারে গভর্নরের বক্তব্য ছিল প্রবলভাবে সতর্কতামূলক ও নেতিবাচক। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের মধ্যে একীভূত হচ্ছে শরিয়াহভিত্তিক ছয় ব্যাংক। কিছু কিছু ব্যাংকের টিকে থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।’ এসব বক্তব্যের ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গ্রাহকেরা অভিযোগ করছেন, ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাচ্ছেন না। অনেকে অনলাইন লেনদেন বন্ধ দেখতে পাচ্ছেন, আবার কেউ নির্ধারিত শাখায় না গেলে টাকা তোলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তব্যাংক বাজারে গ্যারান্টি দিয়ে নগদ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। যদিও গভর্নর বলেছিলেন টাকা ছাপানো হবে না, শেষ পর্যন্ত ২২,৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হয়। তবুও সংকট কাটেনি। একাধিক ব্যাংক দিনে ৫ হাজার টাকার বেশি দিতে পারছে না।
গভর্নরের বিদেশ সফর: ব্যয় বনাম অর্জন
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ৯টি দেশে ৯ বার বিদেশ সফর করেছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন ৬৫ দিন বিদেশে এবং ৯১ দিন সরকারি ছুটিতে, অর্থাৎ দায়িত্ব পালনের ২৮৪ দিনের মধ্যে ১৫৬ দিন অফিসে অনুপস্থিত। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সম্মেলন, চিকিৎসা ও বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
সমালোচকরা বলছেন, অতীতে কোনো গভর্নর এত ঘন ঘন বিদেশ সফরে যাননি। অনেক অনুষ্ঠানে যেখানে নিম্নপর্যায়ের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ যথেষ্ট ছিল, সেখানে সরাসরি গভর্নরের উপস্থিতি অনাবশ্যক ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত এসব ভ্রমণের ব্যয় ও সুফল নিয়ে আছে জবাবদিহির অভাব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সফরের সংখ্যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সফরের অর্জন। এখন পর্যন্ত রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসেনি, এমনকি বিদেশি আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়নি।
ব্যাংকিং খাতে আস্থাহীনতা ও নীতিসহজতার ঘাটতি
ড. মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর চারবার নীতিসুদহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ঋণের সুদ ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৮ শতাংশে নেমেছে। উদ্যোক্তারা যেখানে স্বস্তি আশা করছিলেন, সেখানে সুদ, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানিসংকটের কারণে ভেঙে পড়েছে সেই আশার ভিত্তি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতের দুরবস্থার কথা সবাই জানে, তবে গভর্নরের মুখ থেকে ‘দেউলিয়া’ শব্দ শুনলে আতঙ্ক বাড়ে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন বক্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন। তাঁর উচিত ছিল বাস্তবতা তুলে ধরার পাশাপাশি সংকটের সমাধানে স্বচ্ছ পরিকল্পনা উপস্থাপন।’
শুধু ইসলামি ব্যাংক নয়, নজর দিতে হবে সব দুর্বল ব্যাংকে
সম্প্রতি গভর্নরের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের মন্তব্যও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, শুধু ইসলামি ব্যাংক নয়, প্রচলিত ধারার দুর্বল ব্যাংকগুলোর দিকেও সমান মনোযোগ প্রয়োজন। একতরফা বক্তব্য দিয়ে ব্যাংকিং খাতে বিভ্রান্তি ও আস্থাহীনতা তৈরি করা দায়িত্বশীলতা বহির্ভূত।