“ইচ্ছা ছিল একসঙ্গে গরু বিক্রি করে বাড়িতে যাব। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। আব্বাকে হারালাম। গরু বিক্রি হলো, টাকা পেলাম। কিন্তু আব্বাকে আর পাব না।” — এভাবেই চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন আরিফুল ইসলাম।
টাঙ্গাইলে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত গরু ব্যবসায়ী কোহিনুর শেখের ছেলে আরিফুল ইসলাম এই মুহূর্তে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা পশুর হাটে রয়েছেন। ঈদের আগে বিক্রি করতে আনা তিনটি গরুর মধ্যে দুটি এরইমধ্যে বিক্রি হয়েছে। গরু বিক্রির টাকা হাতে পেলেও চোখেমুখে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট আরিফুলের।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নীচ পলাশী ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা কোহিনুর শেখ ছিলেন নিবন্ধিত জেলে। তিনি পদ্মা নদীতে মাছ ধরে, কৃষিকাজ করে এবং গরু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কোরবানি ঈদ এলেই প্রতিবছর তিন থেকে চারটি গরু হাটে নিয়ে যেতেন বিক্রির জন্য। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
কিন্তু এবারের যাত্রা ছিল তার জীবনের শেষ যাত্রা। গত ১ জুন রাতে, ঈদের আগ মুহূর্তে, ট্রাকে গরু নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন কোহিনুর ও তার ছেলে আরিফুল। রাত সোয়া ১টার দিকে মির্জাপুর থানার দেওহাটা এলাকায় তাদের ট্রাকটি থামানো অবস্থায় ছিল। ঠিক তখনই একটি সবজিবোঝাই ট্রাক পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ট্রাকচাপায় গুরুতর আহত হন কোহিনুর শেখ।
আরিফুল বলেন, “আমি ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নেমে যাই। এক ড্রাইভারের কাছ থেকে পানি চেয়ে এনে আব্বার মাথায় পানি দেই, ডাক দেই—‘আব্বা কথা কন’। কিন্তু আব্বা আর সাড়া দেননি। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানান, তিনি মারা গেছেন।”
দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার এক ঘণ্টা আগেও মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন কোহিনুর। বড় মেয়ে আমেনা খাতুন বলেন, “৩১ মে রাতে আব্বা ফোনে বলেছিলেন—‘যমুনা সেতু পার হয়েছি মা’। এর এক ঘণ্টা পরেই খবর পাই—আব্বা আর নেই।”
কোহিনুর শেখের পরিবারে ছিল এক ছেলে, দুই মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। পরিবারের একমাত্র ভরসা ছিলেন কোহিনুর। মেয়ের ভাষায়—“আমার ভাই এখন এতিম হয়ে গেল। আমরা ভাইবোনেরা এখন অভিভাবকহীন।”
চকরাজাপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার তঞ্জু মোল্লাহ জানান, কোহিনুর শেখ দীর্ঘদিন ধরে গরু পালন করতেন এবং ঈদ এলেই ঢাকা হাটে বিক্রি করতেন। এবারও গরু নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। দুর্ঘটনার পর তার মরদেহ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
আরিফুল বর্তমানে ঢাকায় রয়েছেন। দুইটি গরু বিক্রি করে পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আরেকটি গরু এখনো বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, “বছরে বছর গরু পালব, হাটে আসব, বিক্রি করব। কিন্তু আব্বা তো আর আসবে না। তাকে তো আর ফিরে পাব না।”