নবম দিনের মতো ইরান-ইসরাইল সংঘাতে হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। দুই দেশেরই সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো ইসরাইলি হামলায় দেশটির অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সেনা নিহত হয়েছেন। এমনকি হুমকির মুখে রয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিও।
ইসরাইলের দাবিতে, তারা শনিবার সকালে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে খুজেস্তান প্রদেশ, আহভাজ, বন্দর-ই মাহশাহর এবং ইসফাহানে একযোগে হামলা চালিয়েছে। ইসফাহানের গভর্নরের ডেপুটি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, পারমাণবিক স্থাপনাসহ একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
এদিকে ইরানের পাল্টা হামলায় কাঁপছে তেল আবিব, হাইফা ও ইসরাইলের জ্বালানি ও সামরিক অবকাঠামো। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মোসাদের একটি হেডকোয়ার্টার, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও গবেষণাগার।
ইসরাইল জানিয়েছে, ইরানি ড্রোন তাদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হেনেছে। এ ঘটনাকে বিরল বলে আখ্যা দিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।
ইরানি সংবাদমাধ্যম জানায়, এখন পর্যন্ত দেশটিতে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৪৩০ জন নিহত এবং ৩,৫০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা HRANA এর দাবি, এ সংখ্যা আরও বেশি—৬৫৭ জন। ইসরায়েল নিজেও ২৫ জন নিহত ও প্রায় আড়াই হাজার আহতের কথা জানিয়েছে।
এর মধ্যেই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইরানকে সমর্থন জানাচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, “আমি আশাবাদী, এই লড়াইয়ে জয় ইরানেরই হবে।” তিনি অভিযোগ করেন, ইসরাইল শান্তির পথ রুদ্ধ করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ছড়াচ্ছে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানও বলেন, এই হামলা গোটা অঞ্চলকে “সম্পূর্ণ বিপর্যয়ের দিকে” নিয়ে যাচ্ছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এখন ইস্তানবুলে, যেখানে তিনি আরব ও মুসলিম দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তুরস্ক পৌঁছেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আপনাদের আগ্রাসন চলতে থাকলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।”
ইতোমধ্যে ইরান ২২ জন মোসাদ এজেন্টকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ইসরাইলি হামলার পর এজেন্টদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে জল্পনা চলছে, আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করা হতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে তিনি আগেভাগেই তিনজন জ্যেষ্ঠ ধর্মীয় নেতাকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, ইরান এখন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই তথ্যকে ‘বাড়াবাড়ি’ বললেও, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে।
এমন উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং কূটনীতি ও সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছেন। ক্লিনটন সরাসরি নেতানিয়াহুকে দায়ী করে বলেন, “তিনি অনেক আগে থেকেই এই যুদ্ধ চান।”
সংঘাত এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে উঠছে বলে মত বিশ্লেষকদের। যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরাসরি তেহরানে হামলা চালায়নি, তবে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ অবস্থান এবং তেহরানের ওপর তাদের ছায়া-অভিযান সংঘর্ষকে আরও জটিল করে তুলছে।
সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, জেরুজালেম পোস্ট, ইউরো নিউজ, তাসনিম, রয়টার্স