ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনে ১৭ নভেম্বর একটি বিশেষ দিন। ১৯৬৮ সালের এই দিনে তিনি পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ঠিক একই দিনে—৫৮তম বিবাহবার্ষিকীতে—আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তার রাজনৈতিক যাত্রার শুরুও হয়েছিল ভারত থেকেই; ১৯৮১ সালে দিল্লি থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন।
পারিবারিক উত্তরাধিকারের কারণে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা হওয়ায় ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়। তখন তিনি ভারতে নির্বাসনে ছিলেন। দলের বড় একটি অংশ তার নেতৃত্বে তীব্র আপত্তি জানালেও তিনি শেষ পর্যন্ত শীর্ষ পদে আসীন হন। তিন মাস পর দেশে ফিরে এসে দলের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন ৩৩ বছর বয়সী হাসিনা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করেন। এতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনসহ ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে মত দেওয়ায় ড. কামাল হোসেনও তার বলয়ের নিপীড়নের শিকার হন এবং শেষ পর্যন্ত নতুন দল গঠন করতে বাধ্য হন।
দল গোছানোর পাশাপাশি হাসিনা আন্দোলনেও যুক্ত হন, তবে সমালোচকরা অভিযোগ করেন—১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপি, জামায়াতসহ যৌথ আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি করে এরশাদ সরকারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর আবার একই দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি নিজেকে ‘নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী’ ভাবলেও আওয়ামী লীগের ভরাডুবিতে হতবাক হন এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলেন—যা দলীয় ভিন্নমতের নেতাদের মতে, ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।
তার শাসনামলে সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। একতরফা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতের শীর্ষ ছয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সাঈদীর রায়ের প্রতিবাদে নিরস্ত্র শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও তিনি হয়রানি করেন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম করেন, যার ফল—২০১৪ সালের “বিনাভোট”, ২০১৮ সালের “রাতের ভোট” এবং ২০২৪ সালের “ডামি ভোট” নির্বাচন। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়, সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ভীতি আরোপ করা হয়, এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট–সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন দিয়ে ভিন্নমত দমন করা হয়।
২০২৪ সালে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে তার শাসন টালমাটাল হয়ে পড়ে। জুলাইয়ে সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়ান হাজারো ছাত্র-জনতা। আন্দোলনে ১৪০০ মানুষ প্রাণ হারানোর পর দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থান দেখা দেয়। প্রবল জনরোষের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ছোটবোনসহ ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় এবং গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে।
হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে যান, অনেকে জনরোষের শিকার হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়, এমনকি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিও জনতা গুঁড়িয়ে দেয়।
এবার, পালানোর ১৫ মাসের মাথায়, তার নিজের প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার রায়ে তিনি গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন—যা তার রাজনীতির সমাপ্তি টেনে ইতিহাসের কঠিন একটি অধ্যায় হয়ে রইল।



















