জুলাই বিপ্লবী ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই সংঘটিত এই হামলায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে উঠে এসেছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ক্যাডার ফয়সাল করিম মাসুদ (ছদ্মনাম—দাউদ বিন ফয়সাল)। তদন্তে তার রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিস্তৃত তথ্য সামনে আসছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফয়সাল একসময় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং আদাবর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তিনি ঝটিকা মিছিল, চোরাগোপ্তা হামলা ও গোপন বৈঠকে সক্রিয় ছিলেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, ভারতে পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও কামালের আস্থাভাজন হিসেবে তিনি দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন বলে ধারণা তদন্তকারীদের।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—হামলার কয়েক দিন আগে, ৯ ডিসেম্বর একটি কালচারাল বৈঠকে ফয়সালকে হাদির ঠিক পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, হাদির উদারতা ও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়েই তিনি হামলার প্রস্তুতি নেন।
রহস্যজনক আর্থিক লেনদেন
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানায়, জুলাই বিপ্লবের পর ফয়সালের একাধিক ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলন হয়েছে। স্বল্প সময়ে বড় অঙ্কের লেনদেনের একটি অংশ এসেছে বিদেশ থেকে। অর্থগুলো বৈধ পথে এসেছে কি না, তা যাচাই চলছে। একই সঙ্গে দেশের ভেতর থেকেও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ আসার তথ্য মিলেছে। বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে ভারতে পলাতক কামালের সঙ্গে আর্থিক যোগাযোগের সম্ভাব্য যোগসূত্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, কারা এই অর্থ দিয়েছেন এবং কী উদ্দেশ্যে—তা উদঘাটনই এখন তদন্তের মূল লক্ষ্য। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থপ্রবাহের এই যোগসূত্র হামলার পরিকল্পনা উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
জামিন নিয়ে প্রশ্ন
ফয়সালের বিরুদ্ধে আগেও গুরুতর অভিযোগ ছিল। ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে তার বিরুদ্ধে আদাবর থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট তাকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন, যা পরে আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়। অস্ত্র মামলার আসামি হয়েও জামিনে থেকে এমন ভয়াবহ হামলার সন্দেহভাজন হওয়ায় আইনের শাসন নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
পরিবার, প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা
গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, ফয়সালের পরিবারও আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ফয়সাল হামলার আগে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ করেন এবং ঘটনার দিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি। তদন্তে ইঙ্গিত মিলছে, এটি ছিল সুপরিকল্পিত হামলা—এমনকি রেসকিউ টিমও প্রস্তুত ছিল।
আইটি ব্যবসা ও সংগঠনগত সংযোগ
ফয়সাল ‘অ্যাপল সফট আইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং বেসিসের সদস্য। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ও সদস্যপদ নিয়েও তদন্ত চলছে। বেসিসের এক সদস্য দাবি করেছেন, সুপারিশের মাধ্যমে ফয়সাল সদস্য হন—যদিও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
হাদির ওপর এই সশস্ত্র হামলা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; এটি নির্বাচনি পরিবেশ, প্রার্থী ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর শঙ্কা তৈরি করেছে। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, প্রধান সন্দেহভাজনকে ধরতে অভিযান চলছে এবং জনগণের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।


























