অরাজনৈতিক ব্যানারে শুরু হওয়া চব্বিশের জুলাই আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। আন্দোলন ঠেকাতে উসকানি ও ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি মাঠে নামানো হয় দলীয় শক্তি। এসব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়া অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে, ছাত্র-জনতাকে কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ তিনি সরাসরি দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে। সেই নির্দেশনার ফোনালাপ এখন ট্রাইব্যুনালের নথিতে।
জুলাই–আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বৃহস্পতিবার ওবায়দুল কাদেরসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাত শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল–২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সকলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
মামলার অপর আসামিরা হলেন— আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ওয়ালি আসিফ ইনান।
শুনানিতে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাত আসামির বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক অভিযোগ পড়ে শোনান। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়— নির্দেশ প্রদান, প্ররোচনা ও উসকানি।
কাউন্ট–১: দমন নির্দেশ ও সরাসরি উসকানি
অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১১ জুলাই ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ফোনালাপে ওবায়দুল কাদের কোটাবিরোধী আন্দোলন কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ দেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি বলেন, “মারো না কেন ওদের, প্রশ্রয় দাও কেন”— যা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সহিংসতায় উজ্জীবিত করে।
এছাড়া ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা দেওয়ার বক্তব্যে প্রকাশ্যে সমর্থন জানান কাদের ও আরাফাত। পরদিন ১৫ জুলাই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে ‘রাজাকারদের’ জবাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সহিংসতায় উসকানি দেন কাদের।
১৬ জুলাই ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সময়ে ইন্টারনেটের গতি কমাতে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলককে নির্দেশ দেওয়া এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়রকে হত্যাযজ্ঞে উসকানি দেওয়ার অভিযোগও উঠে আসে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলেই ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ ও চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ ছয়জন শহীদ হন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
কাউন্ট–২: দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়ানোর আহ্বান
১৭ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান কাদের। পরদিন রাজপথে থাকার নির্দেশ দেন তিনি। ১৯ জুলাই কারফিউ ও ‘দেখামাত্র গুলি’র বক্তব্যের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অতিউৎসাহী করে তোলার অভিযোগ আনা হয়। এর ফলে ১৮ ও ১৯ জুলাই সারাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে বলে প্রসিকিউশনের বক্তব্য।
কাউন্ট–৩: চূড়ান্ত দমন পরিকল্পনা
৩ থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠকে পাড়া-মহল্লায় প্রস্তুত থেকে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন কাদের। তার উসকানি ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের ফলেই জুলাই–আগস্টে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয় বলে অভিযোগে বলা হয়।
অন্যান্য আসামিদের ভূমিকা
বাহাউদ্দিন নাছিম কাদেরের সব বৈঠকে উপস্থিত থেকে উসকানিতে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। ৪ আগস্ট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আন্দোলনকারীদের ‘জামায়াত–শিবির ও রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে দেওয়া বক্তব্যে উসকে উঠে ১৩ জন নিহত হন।
মোহাম্মদ আলী আরাফাতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী বহিরাগতদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ, পুলিশের গুলিবর্ষণ নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আনা হয়। তার ভূমিকার ফলেই সাময়িকভাবে চারটি টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করা হয় বলেও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
যুবলীগ সভাপতি পরশ ও সাধারণ সম্পাদক নিখিলের বিরুদ্ধে গোপন বৈঠক, সহিংস নকশা প্রণয়ন ও সরাসরি গুলিবর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। নিখিলের উসকানিতে মিরপুরে ৬৯ জন শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনানের বিরুদ্ধেও সরাসরি উসকানি, হামলায় নেতৃত্ব এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের অভিযোগ আনা হয়।
সব অভিযোগ উপস্থাপন শেষে প্রসিকিউশনের আবেদনের পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে সাত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৯ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়।

























