ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় পুলিশের গুলিতে মাদারীপুরের তিন যুবক নিহত হওয়ার খবরে পরিবারগুলোতে শোকের মাতম চলছে। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, গতকাল মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) মাদারীপুরের সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের দালাল সেলিম খান তিনজনের মৃত্যুর খবর তাঁদের জানান। এই তিনজন ইতালি যেতে ২২ লাখ টাকা করে চুক্তি করেছিলেন সেলিম খান ও তাঁর ভাই শিপন খানের সঙ্গে।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো জানিয়েছে, দুজনের মধ্যে লিবিয়ায় থাকেন শিপন খান আর দেশে থেকে সব কাজ ও লেনদেন করেন সেলিম খান। এদিকে গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন দালাল পরিবারের সদস্যরা।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের হাজী মো. তৈয়ব আলী খানের ছেলে ইমরান খান (২২), রাজৈর উপজেলার দুর্গাবদ্দী গ্রামের ইমারত তালুকদারের ছেলে মুন্না তালুকদার (২৪), একই উপজেলার ঘোষলাকান্দি গ্রামের কুদ্দুস শেখের ছেলে বায়েজিত শেখ (২০)।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২২ লাখ টাকা করে জনপ্রতি নিয়ে সরাসরি তাদের ইতালি পৌঁছে দেবে, এমন শর্তে প্রতিবেশী ও দালাল শিপন খান ও তাঁর বড় ভাই সেলিম খানের সঙ্গে চুক্তি হয় ওই তিনজনের। চুক্তির টাকা দেওয়ার পর গত ৮ অক্টোবর ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন ইমরান খান ও মুন্না। এর মধ্যে তাঁদের সঙ্গে বায়েজিতও যায়।
এদিকে ইমরান লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছে পরিবার। পরিবারের দাবি, ইমারানের মুক্তির জন্য আরও ১৮ লাখ টাকা নেয় দালালেরা। সর্বশেষ ১ নভেম্বর ইমরান তাঁর মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন। তখন ইমরান বলেন, ‘মা এখানে আমাকে অনেক নির্যাতন করা হচ্ছে। জানি না কী হবে।’ তারপর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়নি ইমরানের।
এর ১৮ দিন পর, অর্থাৎ গতকাল মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাতে দালাল সেলিম খান তিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে জানান, তিনজনই পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। হঠাৎ এ খবরে তিন পরিবারে চলছে শোকের মাতম। পাড়াপ্রতিবেশীরা ভিড় করছেন নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, কয়েক বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন শিপন। শিপন সেখানে বসেই মানব পাচারের কাজ করেন। দেশে বসে শিপনের বড় ভাই সেলিম খান ও তাঁর পরিবারের লোকজন এলাকার যুবকদের খুব সহজে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখান। সরাসরি ইতালি নেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলেন। শিপন লিবিয়ায় থাকেন বলে অনেকেই সহজে তাঁদের কথা বিশ্বাস করেন।
এর আগেও এই দালালদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার পথে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। মূলত তাঁরা লিবিয়ার দালালদের ঠিকমতো টাকা দেন না। নিজেরাই টাকা নিয়ে নেন। তাই লিবিয়ার মাফিয়াচক্রের সদস্যরা টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের মেরে ফেলেছে।
আজ বুধবার ইমরানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা রেহেনা বেগম কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও নেই।
ইমরানের বড় বোন ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘শিপন দালাল আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এই দালালের কঠিন বিচার চাই। আর সরকারের কাছে দাবি, আমার ভাইয়ের লাশটি যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। যাতে করে একবারের জন্য হলেও দেখতে পাই।’
ফাতেমা আক্তার আরও বলেন, ‘আমার একমাত্র ভাই। তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের আর তো কেউ থাকল না। আমরা প্রথমে কেউ জানতাম না আমার ভাই শিপনের প্রলোভনে পড়ে ইতালি যাবে বলে সব ঠিক করেছিল। পরে আমাদের জানান। তখন শিপন আর তাঁর ভাই সেলিমের সঙ্গে আমরা কথা বলি। তাঁরা বলেছিলেন, আমার ভাইকে সরাসরি ইতালি নিয়ে যাবেন। ভালো হোটেলে রাখবেন, ভালো খাওয়াবেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। লিবিয়ায় নিয়ে অনেক নির্যাতন করেছেন। তাঁরা অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমার ভাইকে।’
ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য সব জমি বিক্রি করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমাদের থাকার এই বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। ঋণ করেও টাকা দিয়েছি। তবুও ওরা আমার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলল। আসলে শিপন আর সেলিম সব টাকা একাই খেয়ে ফেলেছেন। তাই টাকা না পেয়ে লিবিয়ার দালালেরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি শিপন আর সেলিমের ফাঁসি চাই।’
এদিকে ইমরানের মা রেহেনা বেগম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে, ৪০ লাখ টাকা দিয়েও তাকে বাঁচাতে পারলাম না, আমার আর তো কিছুই থাকল না। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। আমি দালালদের ফাঁসি চাই।’
ইমরানের আত্মীয় শাহাদাত মাতুব্বর বলেন, ‘দালাল শিপনের হাত অনেক লম্বা। এর আগেও একইভাবে কয়েক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করে সে। শিপন খানের কোনো বিচার না হওয়ায় এই অপরাধ থামছেই না। আমরা দালাল শিপন ও তার সহযোগীদের কঠিন বিচার দাবি করছি।’
এদিকে মুন্নার খালা খাদিজা আক্তার বলেন, ‘দালাল শিপনকে ধারদেনা করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। আমার ভাগিনার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এই দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি মুন্নার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
বায়েজিতের বাবা কুদ্দুস শেখ বলেন, ‘আমার ছেলের এমন মৃত্যু কীভাবে মেনে নেব। দালাল প্রথমে স্বীকার করেনি। পরে লিবিয়া থেকে আমাদের জানানো হয়। এই দালাল এখন পালিয়েছে। এতগুলো টাকা দিয়ে ছেলের এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।’
দালাল শিপনের চাচি সেতারা বেগম বলেন, ‘শিপন অনেক মানুষকে ইতালি নিয়েছে। কিন্তু গুলিতে কেউ মারা গেছে বা শিপন কাউকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, এই ঘটনা আমরা এর আগে কখনই শুনিনি।’
এ বিষয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিবিয়ায় গুলিতে তিন যুবকের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



















