চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়া ইউনিয়নের চাঁদুয়াপাড়ার ছেলে মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন—যার জীবনে অভাব ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। সাত ভাইবোনের সংসারে ভূমি অফিসের কর্মচারী বাবা আবদুর রহমানের আয় দিয়ে চলত না সংসার। দুবেলা খাবারের চিন্তা, ছেঁড়া জামা আর জীর্ণ প্যান্টেই বড় হয়েছেন দেলোয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনো কোনো দিন হাতে থাকত মাত্র ২০ টাকা—সেই টাকায় হোটেলে ভাত আর সাথে ফ্রি দেওয়া ডাল-পেঁয়াজেই হতো তাঁর খাবার। তবুও পড়াশোনা ছাড়েননি, কারণ মাথায় বাজত বাবার কথা—‘দেখিস, তুই বিচারক হতে পারিস কি না।’
২০০৪ সালের এক বৃষ্টির দিনে স্কুলের শিক্ষক দীপক চৌধুরীর পরামর্শ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি বাবাকে ডেকে বলেন, দেলোয়ারকে আর কোনো কাজ করানো যাবে না; সামনে বৃত্তি পরীক্ষা, মনোযোগ দিতে হবে। সেই বছরই দেলোয়ার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন—আর বুঝতে পারেন, তাঁর ভিত গড়ে দিয়েছে সেই শিক্ষকই।
জীবনের বড় ধাক্কা আসে ২০১২ সালে—চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই বাবাকে হারান তিনি। পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হলেও বাবার স্বপ্ন তাঁকে থামতে দেয়নি। আবার চেষ্টা করে পরের বছর ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। কিন্তু আইন পড়া ব্যয়বহুল—তাই দিনে ক্লাস, বিকেলে টিউশনি আর রাতে পড়াশোনা—এভাবেই কাটে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। মা ও ভাইবোনের একটাই কথা—‘টাকার চিন্তা করিস না, তুই জজ হবি।’
বিশ্ববিদ্যালয় শেষে শুরু হয় কঠিন পথচলা। ১৩তম, ১৪তম, ১৫তম এবং ১৬তম বিজেএস—প্রতিটি মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন দেলোয়ার। ব্যর্থতার চাপ তাঁকে ভেঙে দিচ্ছিল, কিন্তু বন্ধুরা সবসময় সাহস দিত—হাল ছাড়তে নিষেধ করত, অনেকে সাহায্যও করত। এরপর টিউশনি কমিয়ে পুরো সময় দেন ১৭তম বিজেএসের প্রস্তুতিতে।
২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি—সেই স্বপ্নের দিন। ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর নিজের নাম তালিকায় দেখে কান্না থামাতে পারেননি দেলোয়ার। মনে হচ্ছিল, বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন—সবচেয়ে খুশি তিনিই হতেন। ছেঁড়া শার্ট পরে শাটলে চড়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়া সেই ছেলেটি আজ দেশের বিচারব্যবস্থায় সহকারী জজ।
দেলোয়ার হোসেন বলেন,
“এই পথচলায় পরিবার, বড় ভাই, বন্ধু, শিক্ষক—সবাই আমাকে শক্তি দিয়েছে। আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাদের প্রতি আমি চিরঋণী।”
তিনি আরও বলেন,
“বারবার ব্যর্থ হলেও বন্ধুরা সাহস দিয়েছে। টাকাপয়সার চিন্তা না করে শুধু চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলত। সেই ভালোবাসাই আমাকে নতুন করে লড়তে শিখিয়েছে।”
অভাবের মধ্যেও যে স্বপ্নকে ধরে রাখা যায়, লড়াই করলে তার সুন্দর এক পরিণতি আসে—দেলোয়ার হোসেনের জীবন তারই অনন্য উদাহরণ।


























