ঢাকা ০২:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর কী ঘটেছিলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে-বাইরে

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ০২:৪৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৫১৮ বার পড়া হয়েছে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ছিল দুই ভিন্ন বাস্তবতার মিলন—একদিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে টানটান উত্তেজনার বৈঠক ও আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি, অন্যদিকে শহরের রাস্তায় রাস্তায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, শঙ্কা আর মুক্তির প্রতীক্ষা।

সেদিন দুপুরের আগেই যারা ভারতীয় সেনাদের ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখেছিলেন, তারা অনেকেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। যদিও আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ তখনো সম্পন্ন হয়নি, তবু বিজয় যে অবশ্যম্ভাবী—এ নিয়ে আর বড় কোনো সংশয় ছিল না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১–২০১১ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। একই দিনে বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে ভারত–বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজী এবং ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

তবে এই খবর তখনই সবার কাছে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ পরে রেডিওর মাধ্যমে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শোনে। যদিও কেউ কেউ রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বিবিসিতে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রচারিত অ্যালান হার্টের তথ্যচিত্রে দেখা যায়—মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসছেন, মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করছে চারপাশ, উত্তোলন করছে বাংলাদেশের পতাকা। কোথাও কোথাও তখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, তবু ভারতীয় বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে জনতার উল্লাস আরও বেড়ে যায়।

গবেষকদের মতে, ক্যান্টনমেন্টে যখন আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখন বাইরে বহু মানুষই জানতেন না ভেতরে ঠিক কী হচ্ছে। লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা ও পাকিস্তানের মেজর জেনারেল জামশেদের মধ্যে বৈঠক চলাকালেই ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। সেই দৃশ্য দেখেই মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, মুক্তিযোদ্ধারাও প্রকাশ্যে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষক আফসান চৌধুরীর ভাষায়, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের খবর মানুষের জানা ছিল না। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের রাস্তায় দেখেই মানুষ বুঝে নেয়—পাকিস্তান বাহিনী হেরে গেছে, মুক্তি এসেছে। আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক খবর পরে সবাই রেডিওতেই শোনে।

প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মইনুল হোসেন চৌধুরী, যিনি সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন, পরে লিখেছেন—পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও মানুষের মধ্যে তখনো ভয় ও সন্দেহ কাজ করছিল, ফলে সন্ধ্যায় অনেক রাস্তা ছিল জনশূন্য।

ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের ঘটনা

১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে দফায় দফায় বৈঠক চলছিল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল জামশেদ এবং ভারতের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা আলোচনায় অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তাঁর Surrender at Dacca বইয়ে লিখেছেন, সেদিন সকাল সোয়া ৯টার দিকে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ তাকে নির্দেশ দেন—সেদিনই ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে।

বিভিন্ন বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, সকালেই মিরপুর ব্রিজে পৌঁছে মেজর জেনারেল নাগরা একটি বার্তা পাঠান—“প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।” এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপদে তাকে শহরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়।

এই বৈঠক, বার্তা আর দরকষাকষির মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে ঘটে যায় ইতিহাসের সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত—বাংলাদেশের পূর্ণ বিজয় ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রস্তুত তারেক রহমানের বাসভবন ও অফিস

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর কী ঘটেছিলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে-বাইরে

আপডেট সময় ০২:৪৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ছিল দুই ভিন্ন বাস্তবতার মিলন—একদিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে টানটান উত্তেজনার বৈঠক ও আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি, অন্যদিকে শহরের রাস্তায় রাস্তায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, শঙ্কা আর মুক্তির প্রতীক্ষা।

সেদিন দুপুরের আগেই যারা ভারতীয় সেনাদের ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখেছিলেন, তারা অনেকেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। যদিও আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ তখনো সম্পন্ন হয়নি, তবু বিজয় যে অবশ্যম্ভাবী—এ নিয়ে আর বড় কোনো সংশয় ছিল না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১–২০১১ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। একই দিনে বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে ভারত–বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজী এবং ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

তবে এই খবর তখনই সবার কাছে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ পরে রেডিওর মাধ্যমে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শোনে। যদিও কেউ কেউ রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বিবিসিতে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রচারিত অ্যালান হার্টের তথ্যচিত্রে দেখা যায়—মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসছেন, মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করছে চারপাশ, উত্তোলন করছে বাংলাদেশের পতাকা। কোথাও কোথাও তখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, তবু ভারতীয় বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে জনতার উল্লাস আরও বেড়ে যায়।

গবেষকদের মতে, ক্যান্টনমেন্টে যখন আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখন বাইরে বহু মানুষই জানতেন না ভেতরে ঠিক কী হচ্ছে। লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা ও পাকিস্তানের মেজর জেনারেল জামশেদের মধ্যে বৈঠক চলাকালেই ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। সেই দৃশ্য দেখেই মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, মুক্তিযোদ্ধারাও প্রকাশ্যে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষক আফসান চৌধুরীর ভাষায়, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের খবর মানুষের জানা ছিল না। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের রাস্তায় দেখেই মানুষ বুঝে নেয়—পাকিস্তান বাহিনী হেরে গেছে, মুক্তি এসেছে। আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক খবর পরে সবাই রেডিওতেই শোনে।

প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মইনুল হোসেন চৌধুরী, যিনি সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন, পরে লিখেছেন—পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও মানুষের মধ্যে তখনো ভয় ও সন্দেহ কাজ করছিল, ফলে সন্ধ্যায় অনেক রাস্তা ছিল জনশূন্য।

ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের ঘটনা

১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে দফায় দফায় বৈঠক চলছিল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল জামশেদ এবং ভারতের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা আলোচনায় অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তাঁর Surrender at Dacca বইয়ে লিখেছেন, সেদিন সকাল সোয়া ৯টার দিকে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ তাকে নির্দেশ দেন—সেদিনই ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে।

বিভিন্ন বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, সকালেই মিরপুর ব্রিজে পৌঁছে মেজর জেনারেল নাগরা একটি বার্তা পাঠান—“প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।” এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপদে তাকে শহরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়।

এই বৈঠক, বার্তা আর দরকষাকষির মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে ঘটে যায় ইতিহাসের সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত—বাংলাদেশের পূর্ণ বিজয় ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।