অন্তর্বর্তী সরকারের চালকদের কয়েকটি ভুল ধারণা স্পষ্ট। রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ভুল ধারণা। গণঅভ্যুত্থান কীভাবে শেষ হয়, সে সম্পর্কে ভুল ধারণা। আর সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা– এই জনগণকে আদৌ গণতন্ত্রের হাল ধরার উপযুক্ত মনে করা নিয়ে সংশয়। এ সরকারের অনেকেই নামকরা ও ডিগ্রিধারী। কিন্তু রাজনীতিকে পেশা হিসেবে চেনেন না, মাঠের রাজনীতি কীভাবে চলে, তার জীবনযাপনগত অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে।
রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক রূপান্তর বলে কিছু হয় না। দলই তো স্বার্থগুলোকে জোড়া লাগায়, সংঘাতকে সংসদে নিয়ে যায়, কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখে, জনরোষকে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পথে চালিয়ে দেয়– রাস্তার সহিংসতায় নয়। এই পুরো শ্রেণিটাকেই যদি সন্দেহের চোখে দেখা হয়, আর বড় দলকে যদি বিশেষভাবে শত্রু বানানো হয়, তাহলে আজকের অস্থিরতা কোনো দুর্ঘটনা না– প্রায় অবধারিত ফল।
দ্বিতীয় ভুলটা, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে ভুলভাবে পড়তে চেষ্টা করা, আর সেই ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন ‘বিপ্লবী অগ্রদল’ বানিয়ে তোলা। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ধ্রুপদী উদাহরণগুলোতে দেখা যায়– একটা সংহত সংগঠন বা ছোট জোট, যারা শুধু লড়াই করে না, পতনের পর রাষ্ট্র তৈরির কাজও হাতে নেয়। আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থান তা ছিল না। এখানে গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা কেউই নিতে চায়নি। বড় বড় দল সচেতনভাবেই ‘আমরাই করেছি’ কথাটা উচ্চারণ করেনি।
ছাত্র সংগঠন ছিল, পেশাজীবী ছিল, নাগরিক সমাজ ছিল– কেউ নিজেদের ‘গণপরিষদ’ দাবি করেনি। জুলাইয়ের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান শক্তিশালী ছিল, কারণ এর পরিধি ছিল বিস্তৃত, নেতৃত্ব ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, নৈতিক শক্তি ছিল অদ্বিতীয়। আর ঠিক এই শক্তির ভেতরেই দুর্বলতাও লুকিয়ে ছিল– এমন কোনো একক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি যে পরদিন সকালেই রাষ্ট্রের স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারে।
তাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ক্ষমতাকাঠামো অস্পষ্ট বা ঝুলে রইল। এই ঝুলন্ত অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার যা করল, সেটাই ছিল আসল বিপদ। যেসব আন্দোলন নানা রঙের, আংশিক নেতৃত্বহীন, সেগুলোর পরের গল্প হয়– পুরোনো এলিট, সংগঠিত দল, সামাজিক আন্দোলন আর হঠাৎ আবির্ভূত ত্রাণকর্তারা সবাই মিলে নেতৃত্বের জন্য টানাটানি করে। দায়িত্ববান অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের কাজ না, এই টানাটানির বিজয়ী আগে থেকেই ঠিক করে রাখা; তাদের কাজ হলো সুষ্ঠু সাংবিধানিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তোলা, যাতে জনগণই ঠিক করতে পারে, কে তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি। ড্রইংরুমে বসে, মিডিয়ার আলোয় সাজিয়ে, আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে মুড়ে যখন আপনি নিজের হাতে একটা ‘অগ্রদল’ তৈরি করতে যান, তখন খোলা রূপান্তরকে আপনি নিজের হাতে নাটকে পরিণত করে ফেলেন। আজ যে অবিশ্বাস, তা তাই আশ্চর্য কিছু নয়।
তৃতীয় ভুল ধারণা হলো, এই জনগণকে নাকি এখনও গণতন্ত্রের দায়িত্ব দেওয়া যায় না; আগে নাকি ‘ব্যবস্থা’ ঠিক করা দরকার। শুরুর দিক থেকেই ওপরের ভাষা ছিল এ রকম– ‘আমরা আগে সিস্টেম ঠিক করব।’ সংস্কারের তালিকা লম্বা: প্রতিষ্ঠান বদলাবে, নিয়ম বদলাবে, রাজনীতি নিজেও বদলাবে। মাঝে মাঝে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাষা শোনা যায় এমন যেন তারা কোনো অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার না, বরং রাষ্ট্রের ওপর বসানো এক বোর্ড অব রিসিভারশিপ। যেন স্বৈরাচারের এক রূপ ভেঙে যাওয়ার পর জনগণ নীরবে আরেক রূপকে ম্যান্ডেট দিয়ে দিয়েছে– এবার সেটার পোশাক শুধু টেকনোক্র্যাট আর শুভবোধের।
এখানেই বড় ব্যঙ্গটা। যে আন্দোলন গলা ফাটিয়ে বলেছিল, ‘আমাদের ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্ত নয়’, সেই আন্দোলনকেই এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের না জিজ্ঞেস করেই সবচেয়ে গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমতি হিসেবে। কোনো নির্বাচিত গণপরিষদ ছাড়াই যে সনদ লেখা হয়, সেটা নৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, রাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রের মূল আইন পাল্টানোর একচেটিয়া অধিকার আছে কি?
গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা যত জায়গায়ই দেখি– সংবিধান পাল্টানোর ক্ষমতা গেছে নির্বাচিত সংসদের হাতে, যাকে হয় গণপরিষদ রূপে বসানো হয়েছে, নয়তো আলাদা নির্বাচন করে গঠন করা হয়েছে। অনেক সময়ে শেষে গণভোটও হয়েছে। জনগণ কোনো টেক্সটকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে কিন্তু আগে তাকে সৎভাবে জিজ্ঞেস করতেই হবে।
আমাদের সামনে গণতান্ত্রিক পথটা আসলে খুব জটিল নয়। আগে একটি গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন হোক। যে সংসদ গড়ে উঠবে, তাকেই দ্বৈত দায়িত্ব দেওয়া যাক– একদিকে আইনসভা, অন্যদিকে গণপরিষদ হিসেবে বসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিস্তৃত নীতিগুলোকে কংক্রিট সাংবিধানিক সংশোধনীতে নামিয়ে আনা। তারপর যদি প্রয়োজন হয়, সেই সংশোধনীগুলো জনগণের সামনে গণভোটে তোলা হোক, যেখানে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’– দুটোই সমান সম্মান নিয়ে থাকবে।
আজকের অরাজকতা তাই কোনো অবশ্যম্ভাবী ‘বিপ্লব-পরবর্তী ভূমিকম্প’ নয়। এটি তিনটি একেবারে এড়ানো সম্ভব ভুলের ফসল। যারা আজ ক্ষমতার আসনে বসে আছেন, তারা যদি এই ভুলগুলো স্বীকার করে সংশোধন করতে পারেন, নির্বাচনের রাস্তা তাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাবে।




















