নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাউলশিল্পীর স্বামী সুমন খলিফার (৩৫) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুমনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাউলশিল্পী সোনিয়া আক্তার, তার প্রেমিক মেহেদী হাসানসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) বিকালে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মুন্সী।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন সুমন খলিফার স্ত্রী বাউলশিল্পী সোনিয়া আক্তার (২২), তার প্রেমিক কাশীপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুর এলাকার আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে মেহেদী হাসান ওরফে ইউসুফ (৪২), তার শ্যালক চর কাশীপুরের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে আব্দুর রহমান (২৮), সহযোগী উত্তর নরসিংহপুরের মৃত বাদশার ছেলে বিল্লাল হোসেন (৫৮), সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ির আব্দুল হাই হাওলাদারের ছেলে আলমগীর হাওলাদার (৪৫) এবং একই এলাকার দিদার বক্সের ছেলে নান্নু মিয়া (৫৫)।
মঙ্গলবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত মো. মামুন নামে একজন পলাতক রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে মেহেদী ও তার শ্যালক আব্দুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফতুল্লা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াসিন আরাফাত বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গত সোমবার (১ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ফতুল্লার কাশীপুর ইউনিয়নের মধ্য নরসিংহপুর এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে থেকে সুমন খলিফার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার আন্দারমানিক গ্রামের মন্টু খলিফার ছেলে। দ্বিতীয় স্ত্রী বাউলশিল্পী সোনিয়াকে নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ঘটনার দিন রাতেই ফতুল্লা মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের বাবা মন্টু খলিফা।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান মুন্সী বলেন, ‘তদন্তে নিহতের স্ত্রী ও তার পরকীয়া প্রেমিকের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে অপর আসামিদেরও গ্রেফতার করা হয়। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আসামিদের তথ্য অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি ও একটি সুইস গিয়ার চাকু উদ্ধার করেছে। পরে হত্যার কথা স্বীকারও করেছে তারা।’
তাদের স্বীকারোক্তির বরাতে পুলিশ সুপার জানান, সুমন বেকার ছিলেন। স্ত্রী সোনিয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় দুই মাস আগে এক গানের অনুষ্ঠানে পরিচয় থেকে সোনিয়ার সঙ্গে মেহেদীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে মেহেদীর কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন সোনিয়া। নিয়মিত মোবাইলে কথা বলতেন। বিষয়টি সুমন জেনে যাওয়ায় কলহ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরপরও মেহেদীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন সোনিয়া। গোপনে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মেহেদীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। শেষে দুজনের কাছে দেয়াল হয়ে দাঁড়ান সুমন। পথের কাঁটা সরাতে হত্যার পরিকল্পনা করেন সোনিয়া ও মেহেদী।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৩০ নভেম্বর রাতে সুমনকে নিয়ে সোনিয়া বাসা থেকে বেরিয়ে পঞ্চবটি অ্যাডভেঞ্চার পার্কের সামনে সোহেল দেওয়ানের ক্লাবে বাউলশিল্পী ফাউন্ডেশনের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যান। অপরদিকে মেহেদী ও তার শ্যালক আব্দুর রহমানসহ অন্য আসামিরা রাত ১০টায় জালকুড়ি এলাকায় একত্রিত হন। পরে আলমগীর হাওলাদার ও নান্নু মিয়ার অটোরিকশাযোগে ওই ক্লাবের সামনে যান তারা।
টাকা ধার দেওয়ার কথা বলে রাত ১১টার দিকে সুমনকে অনুষ্ঠান থেকে ডেকে আনেন মেহেদী। পরে অটোরিকশায় করে নরসিংহপুর এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে চাকু দিয়ে এলোপাতাড়ি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করলে বাঁচার জন্য দৌড় দেন। মেহেদী ও বিল্লাল তাকে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। তখন পলাতক অপর আসামি মামুন চাপাতি দিয়ে সুমনের গলায় একাধিক পোঁচ দেন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে চাপাতি ও চাকু একটি ডোবার পাশে ফেলে পালিয়ে যান তারা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘এটি ছিল একটি ক্লু-লেস হত্যা মামলা। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় হত্যার রহস্য উদঘাটন ও আসামিদের শনাক্ত করা হয়। হত্যার পরিকল্পনাকারী ও প্রধান আসামি মেহেদীসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মেহেদী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় সোনিয়া জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিলে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। বিকালে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।’




















