ঢাকা ১০:৩৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ময়মনসিংহ ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে: বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বড় ধ্বংসের

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ১০:১৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
  • ৫২৪ বার পড়া হয়েছে

 

বৃহত্তর ময়মনসিংহ এখন দেশের সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে দাঁড়িয়ে গেছে। হিমালয়ের পাদদেশে সঞ্চিত চাপ, সক্রিয় ফল্টলাইন ও সাম্প্রতিক ঘন ঘন কম্পন—সবকিছু মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সময় এই অঞ্চল ভয়াবহ ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি ১০০–১৫০ বছরে শক্তিশালী (৭ মাত্রা) এবং ২৫০–৩০০ বছরে অতি শক্তিশালী (৮ মাত্রা) ভূমিকম্প ঘটে থাকে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প এখন “ওভারডিউ”। গত কয়েক বছরে ভূমিকম্পের সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় ঝুঁকি আরো বেড়েছে।

সম্প্রতি ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত

গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরতার এই কম্পন ময়মনসিংহসহ দেশের বহু জেলায় অনুভূত হয়। ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দারা জানান, কয়েক সেকেন্ডের কাঁপনেই মানুষ রাস্তায় বের হয়ে আতঙ্কে ছুটাছুটি করে।

ময়মনসিংহে কম্পনের সংখ্যা দ্বিগুণ

২০২৫ সালের শুরু থেকে বিভাগটিতে ২ মাত্রার ওপরে মোট ৪৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে—যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এটি ভূগর্ভে চাপ সঞ্চয়ের সরাসরি ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সিসমিক জোনে ময়মনসিংহই শীর্ষ ঝুঁকিতে

সরকারের সর্বশেষ সিসমিক মানচিত্রে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটকে জোন–১ বা সর্বোচ্চ ঝুঁকির অঞ্চলে রাখা হয়েছে।
এই এলাকায় রয়েছে ডাউকি ফল্ট—৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অত্যন্ত সক্রিয় চ্যুতি। পাশাপাশি রয়েছে মধুপুর ফল্ট ও অন্যান্য মাইনার ফল্টলাইন। ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, ডাউকি ফল্টে জমে থাকা শক্তি যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।

ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলের আশঙ্কা

বড় ভূমিকম্প হলে ময়মনসিংহের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রই বদলে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তিশালী কম্পনে ব্রহ্মপুত্র তার হারানো গতিপথ ফিরে পেতে পারে—যার ফলে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়তে পারে।
ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৭০০–এর দশকের শেষে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সময়।

হিমালয় প্লেটের চাপ বিপজ্জনক পর্যায়ে

গবেষণা অনুযায়ী, ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর ৫ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই সঞ্চিত শক্তি ৮.১ থেকে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে—যা বাংলাদেশকেও ব্যাপকভাবে আঘাত হানতে পারে।

ময়মনসিংহ শহরের নির্মাণ–ঝুঁকি

শহরে নির্মিত অধিকাংশ বহুতল ভবন জাতীয় বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি।
অনেক ভবন জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা—যা ভূমিকম্পে লিকুইফিকেশন প্রক্রিয়ায় মুহূর্তেই ধসে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ায়।
সংকীর্ণ সড়ক, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নড়বড়ে ভবনের কারণে বড় ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

সরকারি উদ্যোগ সীমিত, সচেতনতার ঘাটতি প্রকট

ফায়ার সার্ভিস ময়মনসিংহকে উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করেছে।
কিন্তু নিয়মিত মহড়া, প্রশিক্ষণ ও জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়—বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাজার এলাকায় সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

৭ মাত্রার ভূমিকম্প সীমান্ত এলাকায় হলেও ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হবে।
প্রস্তুতি না থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।

ময়মনসিংহবাসীর করণীয়

  • পরিবারভিত্তিক ভূমিকম্প–প্রস্তুতি পরিকল্পনা
  • নিরাপদ আসবাব ও কাঠামো নিশ্চিত করা
  • বিল্ডিং কোড অনুসারে নির্মাণ ও রেট্রোফিটিং
  • নিয়মিত মহড়ায় অংশ নেওয়া
  • স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্প কখন হবে কেউ জানে না—তবে প্রস্তুত থাকলেই ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

জনপ্রিয় সংবাদ

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প–মামদানি প্রথম বৈঠক: মতভিন্নতা ছাপিয়ে নিউইয়র্কের স্বার্থে সহযোগিতার অঙ্গীকার

ময়মনসিংহ ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে: বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বড় ধ্বংসের

আপডেট সময় ১০:১৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

 

বৃহত্তর ময়মনসিংহ এখন দেশের সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে দাঁড়িয়ে গেছে। হিমালয়ের পাদদেশে সঞ্চিত চাপ, সক্রিয় ফল্টলাইন ও সাম্প্রতিক ঘন ঘন কম্পন—সবকিছু মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সময় এই অঞ্চল ভয়াবহ ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি ১০০–১৫০ বছরে শক্তিশালী (৭ মাত্রা) এবং ২৫০–৩০০ বছরে অতি শক্তিশালী (৮ মাত্রা) ভূমিকম্প ঘটে থাকে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প এখন “ওভারডিউ”। গত কয়েক বছরে ভূমিকম্পের সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় ঝুঁকি আরো বেড়েছে।

সম্প্রতি ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত

গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরতার এই কম্পন ময়মনসিংহসহ দেশের বহু জেলায় অনুভূত হয়। ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দারা জানান, কয়েক সেকেন্ডের কাঁপনেই মানুষ রাস্তায় বের হয়ে আতঙ্কে ছুটাছুটি করে।

ময়মনসিংহে কম্পনের সংখ্যা দ্বিগুণ

২০২৫ সালের শুরু থেকে বিভাগটিতে ২ মাত্রার ওপরে মোট ৪৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে—যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এটি ভূগর্ভে চাপ সঞ্চয়ের সরাসরি ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সিসমিক জোনে ময়মনসিংহই শীর্ষ ঝুঁকিতে

সরকারের সর্বশেষ সিসমিক মানচিত্রে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটকে জোন–১ বা সর্বোচ্চ ঝুঁকির অঞ্চলে রাখা হয়েছে।
এই এলাকায় রয়েছে ডাউকি ফল্ট—৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অত্যন্ত সক্রিয় চ্যুতি। পাশাপাশি রয়েছে মধুপুর ফল্ট ও অন্যান্য মাইনার ফল্টলাইন। ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, ডাউকি ফল্টে জমে থাকা শক্তি যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।

ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলের আশঙ্কা

বড় ভূমিকম্প হলে ময়মনসিংহের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রই বদলে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তিশালী কম্পনে ব্রহ্মপুত্র তার হারানো গতিপথ ফিরে পেতে পারে—যার ফলে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়তে পারে।
ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৭০০–এর দশকের শেষে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সময়।

হিমালয় প্লেটের চাপ বিপজ্জনক পর্যায়ে

গবেষণা অনুযায়ী, ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর ৫ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই সঞ্চিত শক্তি ৮.১ থেকে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে—যা বাংলাদেশকেও ব্যাপকভাবে আঘাত হানতে পারে।

ময়মনসিংহ শহরের নির্মাণ–ঝুঁকি

শহরে নির্মিত অধিকাংশ বহুতল ভবন জাতীয় বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি।
অনেক ভবন জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা—যা ভূমিকম্পে লিকুইফিকেশন প্রক্রিয়ায় মুহূর্তেই ধসে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ায়।
সংকীর্ণ সড়ক, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নড়বড়ে ভবনের কারণে বড় ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

সরকারি উদ্যোগ সীমিত, সচেতনতার ঘাটতি প্রকট

ফায়ার সার্ভিস ময়মনসিংহকে উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করেছে।
কিন্তু নিয়মিত মহড়া, প্রশিক্ষণ ও জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়—বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাজার এলাকায় সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

৭ মাত্রার ভূমিকম্প সীমান্ত এলাকায় হলেও ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হবে।
প্রস্তুতি না থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।

ময়মনসিংহবাসীর করণীয়

  • পরিবারভিত্তিক ভূমিকম্প–প্রস্তুতি পরিকল্পনা
  • নিরাপদ আসবাব ও কাঠামো নিশ্চিত করা
  • বিল্ডিং কোড অনুসারে নির্মাণ ও রেট্রোফিটিং
  • নিয়মিত মহড়ায় অংশ নেওয়া
  • স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্প কখন হবে কেউ জানে না—তবে প্রস্তুত থাকলেই ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।