ঢাকা ০৩:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি থেকে পতনের বিচারঘরে: শেখ হাসিনার চার দশকের পথচলার সমালোচনামুখর পর্যালোচনা

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ১০:৩১:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
  • ৫২৫ বার পড়া হয়েছে

 

পারিবারিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতেই রাজনীতিতে উত্থান ঘটে শেখ হাসিনার। রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। তখন তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনে ছিলেন, আর জাতীয় রাজনীতিতে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়ায় দলটির একটি শক্তিশালী অংশ তাকে শীর্ষ পদে নিয়ে এলেও তীব্র বিরোধিতা ছিল অন্য অংশে।

সেই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন ৩৩ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ধীরে ধীরে নিজস্ব বলয় তৈরি করেন এবং দলের ত্যাগী নেতাদের sidelined করে দেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, ড. কামাল হোসেনসহ অনেক বর্ষীয়ান নেতাই বিভিন্ন সময়ে অবমূল্যায়িত হন বলে আলোচনায় উঠে এসেছে।

দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুর রাজ্জাকও অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় দল ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তিনি ফিরলেও মূল্যায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ায় তাকেও শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হতে হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাককে সম্মান জানাতে অনীহা ছিল দলীয় প্রধানের—এমন অভিযোগও আছে। একইভাবে ওয়ান ইলেভেনে দেওয়া স্বীকারোক্তির কারণে আবদুল জলিল শেষ জীবনে অবহেলিত হন বলে ঘনিষ্ঠরা জানান।

১৯৮০–৯০ দশকে আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত বিতর্ক তৈরি করে। ১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপি–জামায়াত–বামদলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলন ভেঙে সামরিক শাসক এরশাদের নির্বাচনে অংশ নেন। আবার পরাজয়ের পর সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেই যুক্ত হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে নিজের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও আওয়ামী লীগের ফল আসে হতাশাজনক—মাত্র ৮৮ আসন। নির্বাচন ফল মেনে নিতে না চাইলেও দলের নেতাদের কেউ কেউ এটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলে মন্তব্য করেন, আর সে কারণেই তারা শেখ হাসিনার রোষানলে পড়েন।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপশাসন, ভারত–ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর তিনি ফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং নির্বাচিত এমপিদের শপথগ্রহণ বিলম্বিত হয়।

২০০৬–০৭ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংকটে দেশ অচল হয়ে পড়লে ওয়ান ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে দুই নেতা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মুক্তি পান। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা landslide বিজয় অর্জন করেন। সমালোচকরা দাবি করেন, ওয়ান ইলেভেন সরকারকে বৈধতা দেওয়ার আশ্বাসের বিনিময়েই তিনি ক্ষমতায় ওঠেন।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও পরবর্তী শাসনামলে বিরোধী দল দমন, বিচারিক হত্যার অভিযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম–খুন, সংবাদমাধ্যম দমনে কালো আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ, অর্থপাচার, দুর্নীতি, চাটুকার রাজনীতি, মেগা প্রকল্পে অস্বচ্ছতা—এসব অভিযোগ দেশ–বিদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ২০১৪–১৬ সালে জামায়াত–বিএনপি নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বলে সমালোচনা রয়েছে।

২০২৪ সালে চতুর্থবার ক্ষমতায় ফেরার পর শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রাজপথে চলে আসে। সরকারের দমন–পীড়ন আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়। নিহত হয় বহু মানুষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতের নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন। পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।

দেশজুড়ে তার দলের বিরুদ্ধে জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ভাস্কর্য, দলীয় প্রতীক—সবই বিক্ষুব্ধ জনতা ভেঙে ফেলে। শেখ মুজিব পরিবারের নামে থাকা রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণহত্যার বিচারের কাজ শুরু করে। তার গঠিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমেই সম্প্রতি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।


 

জনপ্রিয় সংবাদ

পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি থেকে পতনের বিচারঘরে: শেখ হাসিনার চার দশকের পথচলার সমালোচনামুখর পর্যালোচনা

আপডেট সময় ১০:৩১:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

 

পারিবারিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতেই রাজনীতিতে উত্থান ঘটে শেখ হাসিনার। রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। তখন তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনে ছিলেন, আর জাতীয় রাজনীতিতে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়ায় দলটির একটি শক্তিশালী অংশ তাকে শীর্ষ পদে নিয়ে এলেও তীব্র বিরোধিতা ছিল অন্য অংশে।

সেই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন ৩৩ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ধীরে ধীরে নিজস্ব বলয় তৈরি করেন এবং দলের ত্যাগী নেতাদের sidelined করে দেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, ড. কামাল হোসেনসহ অনেক বর্ষীয়ান নেতাই বিভিন্ন সময়ে অবমূল্যায়িত হন বলে আলোচনায় উঠে এসেছে।

দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুর রাজ্জাকও অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় দল ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তিনি ফিরলেও মূল্যায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ায় তাকেও শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হতে হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাককে সম্মান জানাতে অনীহা ছিল দলীয় প্রধানের—এমন অভিযোগও আছে। একইভাবে ওয়ান ইলেভেনে দেওয়া স্বীকারোক্তির কারণে আবদুল জলিল শেষ জীবনে অবহেলিত হন বলে ঘনিষ্ঠরা জানান।

১৯৮০–৯০ দশকে আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত বিতর্ক তৈরি করে। ১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপি–জামায়াত–বামদলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলন ভেঙে সামরিক শাসক এরশাদের নির্বাচনে অংশ নেন। আবার পরাজয়ের পর সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেই যুক্ত হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে নিজের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও আওয়ামী লীগের ফল আসে হতাশাজনক—মাত্র ৮৮ আসন। নির্বাচন ফল মেনে নিতে না চাইলেও দলের নেতাদের কেউ কেউ এটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলে মন্তব্য করেন, আর সে কারণেই তারা শেখ হাসিনার রোষানলে পড়েন।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপশাসন, ভারত–ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর তিনি ফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং নির্বাচিত এমপিদের শপথগ্রহণ বিলম্বিত হয়।

২০০৬–০৭ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংকটে দেশ অচল হয়ে পড়লে ওয়ান ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে দুই নেতা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মুক্তি পান। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা landslide বিজয় অর্জন করেন। সমালোচকরা দাবি করেন, ওয়ান ইলেভেন সরকারকে বৈধতা দেওয়ার আশ্বাসের বিনিময়েই তিনি ক্ষমতায় ওঠেন।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও পরবর্তী শাসনামলে বিরোধী দল দমন, বিচারিক হত্যার অভিযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম–খুন, সংবাদমাধ্যম দমনে কালো আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ, অর্থপাচার, দুর্নীতি, চাটুকার রাজনীতি, মেগা প্রকল্পে অস্বচ্ছতা—এসব অভিযোগ দেশ–বিদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ২০১৪–১৬ সালে জামায়াত–বিএনপি নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বলে সমালোচনা রয়েছে।

২০২৪ সালে চতুর্থবার ক্ষমতায় ফেরার পর শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রাজপথে চলে আসে। সরকারের দমন–পীড়ন আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়। নিহত হয় বহু মানুষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতের নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন। পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।

দেশজুড়ে তার দলের বিরুদ্ধে জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ভাস্কর্য, দলীয় প্রতীক—সবই বিক্ষুব্ধ জনতা ভেঙে ফেলে। শেখ মুজিব পরিবারের নামে থাকা রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণহত্যার বিচারের কাজ শুরু করে। তার গঠিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমেই সম্প্রতি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়।