ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের সম্ভাবনা ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনার মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, তারা চান ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বে থাকুন, তবে অবিলম্বে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করা হোক—বিশেষত ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিক সরকার।
এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের টিকে থাকা ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালনেও বিএনপির সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে সরকারপক্ষ চাইছে, সেই সমর্থনের ঘোষণা বিএনপির দিক থেকেই আসুক। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ড. ইউনূস দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে রাষ্ট্র বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তাঁর ভাষায়, “পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়।”
এমন অবস্থায় আজ শনিবার বিকেলে বিএনপি নেতারা যমুনায় ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। একই দিন সন্ধ্যায় সরকারপ্রধানের সঙ্গে দেখা করবেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিরা—যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুত্ববহ করে তুলেছে।
ড. ইউনূস এখনও জামায়াত, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম ও এনসিপির মতো দলগুলোর আস্থা ও সমর্থন পাচ্ছেন। এই দলগুলো সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই চায়, তবে প্রক্রিয়ার স্পষ্টতা নিয়েই তাদের আগ্রহ বেশি। গতকাল বিভিন্ন দলের মধ্যে যোগাযোগ ও বৈঠকের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। উত্তেজনা প্রশমনেও নিরপেক্ষ মহল সক্রিয় হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি বর্তমানে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন, সমকালকে বলেন, “বর্তমান সংকটের একমাত্র সমাধান দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা। বিচার ও সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু নির্বাচন অনিবার্য।”
এদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ তাহেরও স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ছাড়া কোনো কৌশলই কার্যকর হবে না। চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করীম সরকারকে সমর্থন জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপির বক্তব্য ও কৌশল
বিএনপির নেতারা অভিযোগ করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং নানা ইস্যু তুলে নির্বাচনের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, এই পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলেছে রাষ্ট্র পরিচালনার গতি। তাদের দাবি, নির্বাচন নিয়ে আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি কখনও ইউনূসের পদত্যাগ দাবি করেনি। তিনি নিজেই যদি দায়িত্ব ছাড়তে চান, সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত। তবে বিএনপির মূল দাবি রয়ে গেছে—নির্বাচনের রোডম্যাপ।
গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর বলেন, সরকার সংকট থেকে নজর ঘোরাতে নাটকীয়তা তৈরি করছে।
শক্তি দেখিয়েছে বিএনপি, একমত মিত্ররা
বিএনপির মতে, ‘জুলাই আন্দোলন’-এর মাধ্যমে সরকার পতনের পর সংবিধান সংশোধন, গণভোট, এবং নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ, ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি, এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ঘিরে পরিস্থিতি জটিল আকার নেয়।
মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আলোচনা জোরদার হয়েছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, উত্তেজনা প্রশমনই এখন জরুরি এবং সমঝোতার পথেই সবার অগ্রসর হওয়া উচিত।
জামায়াত ও অন্যান্য দলগুলোর তৎপরতা
ড. ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনা শুরুর পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাব এসেছে। এক শীর্ষ জামায়াত নেতা জানান, সেনাবাহিনীর বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা বিপজ্জনক হতে পারে এবং এতে পরিস্থিতি আরও অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে।
বৃহস্পতিবার রাতেই ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এনসিপি এবং খেলাফত মজলিসের নেতারা। এই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানানো হয়, যদিও পরদিন গণঅধিকার পরিষদ তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ এবং রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তোলে।