বাংলাদেশে গুম ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে গঠিত গুম-সংক্রান্ত কমিশন। মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক গুম ও নির্যাতনের পদ্ধতি বিষয়ে কমিশনের একটি আংশিক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এতে র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহৃত গোপন নির্যাতনকক্ষ, ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন ও দীর্ঘ সময় ধরে ভুক্তভোগীদের গোপনে আটকে রাখার বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২3 সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে গুমকে একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি’ হিসেবে চর্চা করা হয়েছে। বিশেষভাবে নির্মিত শব্দনিরোধক নির্যাতনকক্ষে ভুক্তভোগীদের রেখে একের পর এক শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন চালানো হতো, যাতে তাদের চিৎকার বা কান্নার শব্দ বাইরের কেউ না শুনতে পারে।
র্যাব-২ এর সিপিসি-৩ ইউনিট এবং টিএফআই সেল-এ ছিল অত্যাধুনিক নির্যাতন যন্ত্রপাতি। বৈদ্যুতিক শর্ট দেওয়া হতো চেয়ারে বসিয়ে, ব্যবহার করা হতো ঘূর্ণায়মান চেয়ার, নখ তুলে ফেলার উপকরণ, এবং হাত-পা বাঁধার বিশেষ রশি। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে ওষুধ ও মলম লাগিয়ে দাগ মুছে ফেলা হতো, এরপর জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো তাদের।
কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এসব নির্যাতনের উদ্দেশ্য ছিল ‘মানসিক ভীতি তৈরি করে স্বীকারোক্তি আদায়।’ ভুক্তভোগীদের অর্ধেক পরিমাণ খাবার দেওয়া হতো, আর রাখা হতো চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে।
কমিশন নির্যাতনের অন্তত ১০টি পদ্ধতি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে রয়েছে:
-
ঘুম বঞ্চিত করে মানসিকভাবে অস্থির করা
-
বৈদ্যুতিক শক
-
লাঠিপেটা
-
পানি ও খাবার কম দেওয়া
-
চোখ বেঁধে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা
-
জিজ্ঞাসাবাদের নামে ক্রমাগত চিৎকার
-
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা
-
শ্বাসরোধের উপকরণ ব্যবহার
-
বারবার স্থানান্তরের মাধ্যমে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলা
-
ওষুধ প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা দুর্বল করা
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক গুম ভুক্তভোগীকে বছরের পর বছর গোপন স্থানে রাখা হতো—মাসের পর মাস পরিবারের কোনো খোঁজ না পেয়ে ধীরে ধীরে তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলত।
কমিশনের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় গুমের পদ্ধতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক প্রথমবারের মতো নথিভুক্ত হলো। প্রতিবেদনের প্রকাশের পর তা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, দোষীদের বিচার এবং গুমের শিকার পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।