ঢাকা ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিজ হাতে গড়া ট্রাইব্যুনালেই শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড: গণঅভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধে ঐতিহাসিক রায়

  • ডেস্ক রিপোর্টঃ
  • আপডেট সময় ০৩:১৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
  • ৫৪৮ বার পড়া হয়েছে

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।讣 যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিচালনার উদ্দেশ্যে দেড় দশক আগে তাঁর সরকারই যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল, আজ সেই ট্রাইব্যুনালেই ঘোষণা হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় ও যুগান্তকারী এই রায়।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার মামলাটির রায় ঘোষণার তারিখ আজ ১৭ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

১৫ বছর পর নিজ দলের নেতার বিরুদ্ধে একই ট্রাইব্যুনালে বিচার

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের কার্যক্রম। স্বাধীনতার চার দশক পর যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিচালনার মূল কাঠামো তৈরি করেছিলেন শেখ হাসিনা।

কিন্তু ১৫ বছর পর, সেই একই কাঠামোতেই তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হলো—মৃত্যুদণ্ডের রায়ে শেষ হলো বিচারপথ।

পালিয়ে যাওয়া দুই নেতা ও ‘প্রকৃতির বিচার’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতের উদ্দেশে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার পাশে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল—এই মামলার ‘অন্যতম কমান্ডার’।

কিন্তু বাঁচতে পারেননি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। হুকুমদাতাদের অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে। পরে বিচারে সুবিধা পেতে তিনি রাজসাক্ষী হতে চেষ্টা করেন।

প্রসিকিউশনে থাকা অনেক আইনজীবী আগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামিপক্ষে ছিলেন। তাদের ভাষায়,
“এটাই প্রকৃতির বিচার—নিজ হাতে গড়া আইনেই নিজের বিচার।”

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন,
“শেখ হাসিনার তৈরি ট্রাইব্যুনালেই তাঁর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে—এটি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য বড় শিক্ষা।”

মামলা নম্বর ২/২০২৫: তদন্ত, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও চার্জশিট

২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট শুরু হয় তদন্ত। ১৬ অক্টোবর মিস কেস ফাইল হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে সেদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পরদিন জারি হয় কামাল ও মামুনের নামে।

২০২৫ সালের ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা, আর ১ জুন ফরমাল চার্জ দাখিল করে প্রসিকিউশন।

১০ হাজার পৃষ্ঠা দালিলিক সাক্ষ্য, ৮৪ জন সাক্ষী

ফরমাল চার্জে মোট ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার তথ্য-প্রমাণ জমা দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ছিল—

  • দেশি-বিদেশি অনুসন্ধান প্রতিবেদন

  • শহীদ-আহতদের তালিকা

  • ঘটনাস্থলভিত্তিক নথিপত্র

  • পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

  • বুলেট-অস্ত্রের হিসাব

  • হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল

  • ভিডিও, অডিও, ডিভিডি, পেনড্রাইভসহ ৩২টি বস্তু প্রদর্শনী

  • ৯৩টি দালিলিক প্রদর্শনী

  • ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি (৫৪ জন সরাসরি সাক্ষ্য দেন)

পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত—জানালো প্রসিকিউশন

প্রসিকিউশন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনে। এগুলো হলো—

১. উসকানি

১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে “রাজাকার” বলা।
সেই রাতেই ঢাবি ভিসি মাকসুদ কামালকে ফোন করে দমন-পীড়নের নির্দেশ।

২. সরাসরি হত্যার নির্দেশ

১৮ জুলাই সাবেক মেয়র তাপসকে ফোনে—

  • মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ

  • হেলিকপ্টার থেকে গুলি

  • ড্রোনে অবস্থান শনাক্তের নির্দেশ

এই নির্দেশনার পর দেশজুড়ে ১৪০০ ছাত্র-জনতা নিহত, কয়েক হাজার আহত হন।

৩. আবু সাঈদ হত্যা (বেরোবি)

৪. চানখারপুলে ছয় হত্যা

৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া

প্রসিকিউশনের দাবি—পাঁচ অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তাই সর্বোচ্চ শাস্তি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শহীদ-আহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন জানানো হয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

নিজ হাতে গড়া ট্রাইব্যুনালেই শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড: গণঅভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধে ঐতিহাসিক রায়

আপডেট সময় ০৩:১৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।讣 যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিচালনার উদ্দেশ্যে দেড় দশক আগে তাঁর সরকারই যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল, আজ সেই ট্রাইব্যুনালেই ঘোষণা হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় ও যুগান্তকারী এই রায়।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার মামলাটির রায় ঘোষণার তারিখ আজ ১৭ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

১৫ বছর পর নিজ দলের নেতার বিরুদ্ধে একই ট্রাইব্যুনালে বিচার

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের কার্যক্রম। স্বাধীনতার চার দশক পর যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিচালনার মূল কাঠামো তৈরি করেছিলেন শেখ হাসিনা।

কিন্তু ১৫ বছর পর, সেই একই কাঠামোতেই তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হলো—মৃত্যুদণ্ডের রায়ে শেষ হলো বিচারপথ।

পালিয়ে যাওয়া দুই নেতা ও ‘প্রকৃতির বিচার’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতের উদ্দেশে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার পাশে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল—এই মামলার ‘অন্যতম কমান্ডার’।

কিন্তু বাঁচতে পারেননি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। হুকুমদাতাদের অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে। পরে বিচারে সুবিধা পেতে তিনি রাজসাক্ষী হতে চেষ্টা করেন।

প্রসিকিউশনে থাকা অনেক আইনজীবী আগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামিপক্ষে ছিলেন। তাদের ভাষায়,
“এটাই প্রকৃতির বিচার—নিজ হাতে গড়া আইনেই নিজের বিচার।”

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন,
“শেখ হাসিনার তৈরি ট্রাইব্যুনালেই তাঁর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে—এটি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য বড় শিক্ষা।”

মামলা নম্বর ২/২০২৫: তদন্ত, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও চার্জশিট

২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট শুরু হয় তদন্ত। ১৬ অক্টোবর মিস কেস ফাইল হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে সেদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পরদিন জারি হয় কামাল ও মামুনের নামে।

২০২৫ সালের ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা, আর ১ জুন ফরমাল চার্জ দাখিল করে প্রসিকিউশন।

১০ হাজার পৃষ্ঠা দালিলিক সাক্ষ্য, ৮৪ জন সাক্ষী

ফরমাল চার্জে মোট ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার তথ্য-প্রমাণ জমা দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ছিল—

  • দেশি-বিদেশি অনুসন্ধান প্রতিবেদন

  • শহীদ-আহতদের তালিকা

  • ঘটনাস্থলভিত্তিক নথিপত্র

  • পোস্টমর্টেম রিপোর্ট

  • বুলেট-অস্ত্রের হিসাব

  • হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল

  • ভিডিও, অডিও, ডিভিডি, পেনড্রাইভসহ ৩২টি বস্তু প্রদর্শনী

  • ৯৩টি দালিলিক প্রদর্শনী

  • ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি (৫৪ জন সরাসরি সাক্ষ্য দেন)

পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত—জানালো প্রসিকিউশন

প্রসিকিউশন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনে। এগুলো হলো—

১. উসকানি

১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে “রাজাকার” বলা।
সেই রাতেই ঢাবি ভিসি মাকসুদ কামালকে ফোন করে দমন-পীড়নের নির্দেশ।

২. সরাসরি হত্যার নির্দেশ

১৮ জুলাই সাবেক মেয়র তাপসকে ফোনে—

  • মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ

  • হেলিকপ্টার থেকে গুলি

  • ড্রোনে অবস্থান শনাক্তের নির্দেশ

এই নির্দেশনার পর দেশজুড়ে ১৪০০ ছাত্র-জনতা নিহত, কয়েক হাজার আহত হন।

৩. আবু সাঈদ হত্যা (বেরোবি)

৪. চানখারপুলে ছয় হত্যা

৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া

প্রসিকিউশনের দাবি—পাঁচ অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তাই সর্বোচ্চ শাস্তি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শহীদ-আহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন জানানো হয়।